প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষ ও ব্যবসা রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ায় করোনা মহামারি অন্য দেশের মতো বাংলাদেশে আঘাত হানতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ কোভিড-১৯ এর শিকার হতে পারতো। কিন্তু আমরা আমাদের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষ ও ব্যবসা রক্ষায় দ্রুত কাজ করেছি। এর ফলে, অন্য দেশের মতো বাংলাদেশে মহামারি আঘাত হানতে পারেনি। এক দশক আগে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক পুনরুত্থান অব্যাহত রাখতে আমরা মহামারি থেকে একটি ভালো অবস্থানে উঠে এসেছি।’
সোমবার নিউইয়র্ক ভিত্তিক মার্কিন বহুজাতিক ব্যবসায়িক সাময়িকী ‘ফরচুন’ এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘মানুষের প্রয়োজন এবং যেখানে তারা কর্মরত সেই ব্যবসাকে গুরুত্ব দিয়ে জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পদক্ষেপ নিয়েছি।’
তিনি বলেন, গত বছর মহামারির শুরুর দিকে সরকার হতদরিদ্র, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, অভিবাসী, সুবিধা বঞ্চিত নারীদের ত্রাণ প্রদান করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা চার কোটি—মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ– মানুষকে দ্রুত নগদ অর্থ ও অন্যান্য সহযোগিতা করেছি। ২২ দশমিক ১ মার্কিন ডলার ব্যয়ে এ গুলো ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে। আর এটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৬ দশমিক ২ শতাংশ। আমরা টিকা ও অন্যান্য জরুরি ব্যবস্থার জন্য আরও শত কোটি টাকা ব্যয় করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যা করেছি তার কেন্দ্রে সব সময় জনগণ থেকেছেন। ‘কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে না’ সরকার এই নীতি প্রণয়ন করে যার মাধ্যমে এক কোটি ৬৮ লাখ মানুষকে চাল, শিশু খাদ্য ও নগদ অর্থ দেয়া হয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা বয়স্ক, প্রতিবন্ধী,বিধবা ও নিঃস্ব মহিলাদের জন্য অর্থ প্রদানের লক্ষ্য রেখেছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ করতে মহামারির আগে উদ্বোধন করা একটি কর্মসূচি সম্প্রসারিত করেছি। আর এই কর্মসূচি আমাদের করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যাপক অবদান রেখেছে।’
তিনি বলেন, সরকার ছোট ব্যবসা ও তাদের কর্মচারীদের সহায়তা করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বিশেষ করে নারী ও কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণ দিয়েছে সরকার। সুবিধাজনক শর্তে সরকারি ঋণ পর্যটন শিল্পে শ্রমিকদের অর্থ প্রদানের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৃহত্তর ব্যবসাগুলোকেও সহায়তা করা হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পসহ রপ্তানিমুখী শিল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধের জন্য শত কোটি টাকা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বড় নির্মাতা ও তথ্য প্রযুক্তি কোম্পানিসহ দ্রুত বর্ধনশীল পরিষেবা সচল রাখতে একটি কার্যকরী-মূলধন ঋণ সুবিধা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সব বাণিজ্যিক ঋণের সুদের অর্থ প্রদান গত বছর দুই মাস স্থগিত করা হয়। পরে নিয়োগকারীদের ওপর আর্থিক বোঝা কমানোর জন্য তা আরও ১২ মাস ছাড় দেয়া হয়।’
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও সামাজিক দূরত্ব প্রবর্তন করেছে, মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে এবং গত বছরের মার্চের শেষ থেকে জুনের শুরু পর্যন্ত ৬৬ দিনের সরকারি ছুটি দিয়েছে।
তিনি বলেন, শিল্প উৎপাদন কমে গেছে। ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী লকডাউন চাহিদা হ্রাস করেছে এবং আমাদের সমগ্র অর্থনীতিকে ধাক্কা দিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘তবে আমরা কখনই নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারাইনি এবং আমাদের জনগণের জন্য বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছি। আমরা (করোনা) পরীক্ষার সুবিধা স্থাপন করেছি। আমরা কন্টাক্ট ট্রেসিং করেছি। আমরা সারা দেশের হাসপাতালে আইসোলেশন সুবিধা স্থাপন করেছি। এছাড়া আমরা ছয় হাজার ২০০ চিকিৎসক, ১০ হাজার নার্স ও তিন হাজার অন্যান্য প্রধান চিকিৎসাকর্মী নিয়োগ করেছি। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় পর্যায়ে বছরের পর বছর বিনিয়োগের জন্য অনেক চাপ সত্ত্বেও আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সহনশীল ছিল।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘নতুন উদ্যোগ ও অতীত বিনিয়োগের সমন্বয় অগণিত জীবন বাঁচিয়েছে এবং আমাদের অর্থনীতিকে ঝড় মোকাবিলা করতে দিয়েছে। গত বছরের নভেম্বর থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি মোটামুটি দুই শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত এক দশকে আমাদের মাথাপিছু আয় তিনগুণ বেড়ে ২০২১ অর্থবছরে দুই হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার হয়েছে যা প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। মহামারি আমাদের অগ্রগতিতে বাধা দিতে পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশেষভাবে গর্বিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশকে সপ্তম স্থানে রেখেছে। আমাদের শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৩ দশমিক ৬৭ এ হ্রাস পেয়েছে। মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৭৩-এ নেমে এসেছে। বাংলাদেশিদের গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল অভিযোজন ও দক্ষতার ক্ষেত্রেও বিশ্বনেতা হয়ে উঠেছে। আমাদের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগ অর্থনীতিতে রূপান্তর ও বৈচিত্র্য এনেছে। এটি কোভিড-১৯ এর সঙ্গে লড়াই করা সহজ করে তুলেছে। বাংলাদেশিরা এখন তাদের স্মার্টফোনের ওপর নির্ভরশীল। ফলে,মহামারি সম্পর্কে তারা প্রতিনিয়ত অবহিত থাকছেন।’
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দরিদ্রতম দেশ থেকে এ বছর নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ। ‘আমরা ২০২৬ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রয়েছি। একশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক মহামারি সত্ত্বেও এই সব এখনও সম্ভব। জনগণে বিনিয়োগ এই পার্থক্য এনেছে।’
—-ইউএনবি
আরও পড়ুন
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
কমতে শুরু করেছে কুড়িগ্রামের নদীর পানি, ভাঙন আতঙ্কে মানুষ
দিনাজপুরে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় নিহত ২