নিজস্ব প্রতিবেদক:
সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ায় দেশের ১০ লক্ষাধিক মানুষ নিজ পেশায় ফিরেছেন। একই সঙ্গে তাদের দুর্বিষহ জীবনের অবসান ঘটেছে। সুন্দরবন ঘিরে মাছ ধরা, মধু আহরণ, বাওয়ালি, কাঁকড়া শিকার, রেণু শিকার, ছন কাটাসহ বিভিন্ন কাজ করে দেশের ১০ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হতো। বন বিভাগের অনুমোদন নিয়ে তারা এসব পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু সুন্দরবনের ৩২টি দস্যু বাহিনীর অত্যাচারে বহু বছর এসব পেশায় কাজ করতে পারেননি তারা। তিন বছর আগেও জলদস্যুদের অভয়ারণ্য ছিল সুন্দরবন।
জেলে, বাওয়ালী, মৌয়াল এমনকি বনরক্ষী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও দস্যুরা ছিল ‘মূর্তিমান আতংক’। সুন্দরবনে দস্যুদের কবলে পড়েননি বনসংশ্লিষ্ট এমন পেশাজীবীদের সংখ্যা খুবই কম। বলতে গেলে জলদস্যুদের কাছে জিম্মি ছিলো সুন্দরবন। ট্রলারে হামলা চালিয়ে জাল ও মাছ লুট এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিতদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা দস্যুদের কাছে ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। মুক্তিপণ না দিলে দস্যুদের আস্তানা থেকে কোন পেশার মানুষের মুক্তি মেলেনি। দস্যুদের অত্যচারে জেলে, মাওয়ালি, বাওয়ালীসহ সব পেশার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, জলদস্যুরা হরিণ-বাঘও শিকার করতো। এতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য হারাতে বসেছিল।
জলদস্যুদের কারণে পর্যটকদের যাতায়াতের কাজে ব্যবহৃত শতাধিক বোট বন্ধ ছিল। এতে বোট মালিকসহ সহস্রাধিক মানুষ মানবেতর জীবন কাটান বহু দিন। এমন অবস্থার মধ্যে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তৎকালীন র্যাব ডিজিকে প্রধান সমন্বয়কারী করে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে গোড়াপত্তন ঘটে সুন্দরবনকে জলদস্যু মুক্তকরণ প্রক্রিয়ার। র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদের সার্বিক নির্দেশনায় ২০১৫ সাল থেকে টানা তিন বছর র্যাবের অভিযানে দস্যুমুক্ত হয় সুন্দরবন।
ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ খ্যাত পৃথিবীর বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলটিকে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর দস্যুমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর জলদস্যু না থাকায় সাহস ফিরে পেয়েছেন বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত দেশের ১০ লাখ মানুষ। এখন নিরাপদে নিজ পেশায় কাজ করছেন তারা। অথচ তিন বছর আগে মানবেতর জীবন-যাপন করতেন তারা। আর্থিক সংকটে পড়ে অনেকে অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটিয়েছেন বহু বছর। এখন তারা নিজ পেশায় ফিরতে পারায় তাদের পরিবারে আর্থিক স্ব”ছলতা এসেছে। ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধি সরেজমিনে গিয়ে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিতদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পেয়েছেন। এদিকে দস্যুমুক্ত হওয়ায় বন বিভাগের বন্ধ ক্যাম্পগুলোও চালু হচ্ছে। বন বিভাগের সুন্দরবনে দুটি বিভাগ আছে- একটি সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ, আরেকটি সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগ।
সুন্দরবনে বনায়ন রক্ষার কাজে নিয়োজিত প্রহরীদের ১২টি ক্যাম্প জলদস্যুদের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এসব ক্যাম্পে অস্ত্র নিয়ে প্রহরীরা থাকতেন। এখন আবার এসব ক্যাম্প চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে শেলারচর ক্যাম্প চালু হয়েছে। টিয়ারচর ক্যাম্প চালুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। অন্যান্য ক্যাম্পগুলোও চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনে বন বিভাগ, পূর্ব এর ফরেস্টার আব্দুল মান্নান বলেন, শেলারচর ও টিয়ারচর ক্যাম্প ছাড়াও দুধমুখী, মরাখোলা, মিরগামারী ও ছাপসি ক্যাম্প চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে বন বিভাগের ক্যাম্পগুলোর বর্তমান অবস্থা খুবই করুণ। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় ভেঙেচুরে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। বনায়ন রক্ষায় বন বিভাগের ক্যাম্পে জনবল বাড়ানো জরুরি বলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান।
সংগ্রহকারীদের বলা হয় বাওয়ালি৷ বনবিভাগ থেকে অনুমোদন নিয়ে সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাওয়ালিরা সুন্দরবনে অবস্থান করেন। তবে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর সুন্দরবনে কাঠ কাঁটার মৌসুম আর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি গোলপাতা কাঁটার মৌসুম। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সুন্দরবন থেকে গরান, হেতাল, গেওয়া, সুন্দরী, পশুর, ধুন্দল, গোলপাতা ও বাইন কাঠ কাঁটার অনুমতি প্রদান করত বনবিভাগ৷ আশির দশকে পশুর কাঠ কাঁটার অনুমতি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নব্বই দশকে সুন্দরী, গেওয়া ও হেতালের পারমিটও বন্ধ করে দেয় বনবিভাগ। ২০০৭ সালে সাইক্লোন সিডরের আঘাতে সুন্দরবন লণ্ডভণ্ড হলে ওই বছর থেকে গরান গাছ কাঁটার অনুমতিও দেওয়া হচ্ছেনা। সব মৌসুমেই জেলেরা সুন্দরবনে মাছ শিকার করে থাকে। তবে শীত মৌসুমে সবচেয়ে বেশি জেলে সুন্দরবনে আসেন মাছ ধরতে। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে জেলেরা সুন্দরবনের ভেতরের নদী ও খালে মাছ শিকার করেন। নড়াইলের চিত্রা নদী তীরের একদল মৎস্যজীবী ছোট ছোট নৌকায় চেপে সুন্দরবনের ভেতরে উদ্বিড়াল বা ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরেন। জাল পেতে পোষা ভোঁদড়দের তারা ছেড়ে দেন নদীতে। পানির মধ্য থেকে মাছ তাড়িয়ে আনলে জাল তুলে ফেলেন তারা। এক শ্রেণীর পেশাজীবী আছেন যারা কেবল সুন্দরবনে আসেন কাঁকড়া শিকার করতে৷ ছোট ছোট নৌকাযোগে এসব মানুষ সুন্দরবনের খালে, নদীতে কাঁকড়া শিকার করেন।
আরেক দল সুন্দরবনের নদী-খালে মাছের পোনা সংগ্রহ করে চাষিদের কাছে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সুন্দরবনের পার্শ্ববতী এলাকাগুলোর অনেক নারী ও শিশু এ পেশায় নিয়োজিত। মৌয়ালরা সুন্দরবনের গহীনে মধু সংগ্রহ করেন। এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে বনবিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে এরা একেক যাত্রায় সাধারণত পনের দিন বনের ভেতর মধু সংগ্রহ করেন। সুন্দরবনের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে অনেক তৃণভূমিতে জন্ম নেয় প্রচুর ছন গাছ৷ ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে এসব ছন কাঁটার জন্য একদল পেশাজীবী সুন্দরবনে আসেন। ছন গাছ বিভিন্ন এলাকায় ঘরের ছাউনি ছাড়াও পানের বরজে ব্যবহৃত হয়। সুন্দরবনের জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ। এরকম নানান হিংস্র বন্যপ্রাণীকে মোকাবেলা করে বছরের বড় একটা অংশ জঙ্গলে কাটিয়ে দেন সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল পেশাজীবীরা। সুন্দরবন জলদস্যুমুক্ত হওয়ায় এখন তারা অনেক খুশি।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি