November 24, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, July 24th, 2022, 9:50 pm

দেশকে ভোগাচ্ছে লোকসানি ভর্তুকি

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

লোকসানি ভর্তুকিই দেশকে ভোগাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের ইতিহাসের অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ভর্তুকির পরিমাণ। সরকার যেসব খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। কৃষি খাতে ভর্তুকির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সার। বিদ্যুৎ, কৃষি উপকরণ, উন্নত মানের বীজ কেনায় কৃষকদের ভর্তুকি দেয়া হয়। বিদ্যুৎ খাতের মধ্যে বিদ্যুৎ অন্যতম আর জ্বালানি খাতের মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) অন্যতম। তাছাড়া পাট ও পোশাক রপ্তানি খাত ও প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রেও প্রণোদনা দেয়া হয়। ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় নগদ ঋণ নামেও একটি অধ্যায় আছে। যাকে ভর্তুকিই বলা চলে। ওই ঋণ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ইত্যাদি সংস্থাকে দেয়া হয়। আগে প্রতিবছর ২-৩ হাজার কোটি টাকা করে বাড়লেও এবার ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির সাপেক্ষে সংশোধিত বাজেটে ওই ভর্তুকি আরও বাড়ার কথা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে পায়রার পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারায় প্রতি মাসে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানিকে ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ওই ১০০ কোটি টাকার মধ্যে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিবি) প্রতি মাসে ২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। কারণ ওই সংস্থাটি নির্ধারিত সময়ে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে পারেনি। কয়েক বছর ধরেই দেশে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। এ অবস্থায় যেসব কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা কাজে লাগে না সেগুলোকে ভর্তুকি দিতে হয়। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কোম্পানি বসে বসে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ওই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে সরকার। মূলত অতি প্রয়োজনীয় কিছু ভর্তুকির পাশাপাাশি কিছু লোকসানি ভর্তুকি দেশকে ভোগাচ্ছে।
সূত্র জানায়,
সূত্র জানায়, সরকার বিদ্যুৎ খাতে গত অর্থবছর ৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। আর গত অর্থবছর (২০২১-২২) ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে ভর্তুকি দেয়া হয় ১০ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। তবে ক্রমেই ঘাটতি বাড়তে থাকায় ভর্তুকি দেয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির শুনানি হয়েছে। তাতে বিপিডিবি বাল্ক মূল্যহার প্রায় ৬৯ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। আর কারিগরি কমিটি ৫৮ শতাংশ দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। পিডিবি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলেছে, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করায় গত অর্থবছরে (২০২০-২১) ১১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। উৎপাদন ব্যয়ের কমে বিদ্যুৎ বিক্রি করায় এ অর্থবছরে বিপিডিবির লোকসান হতে পারে ৪০ হাজার কোটি টাকা। তবে গত এপ্রিল পর্যস্ত পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ১০ হাজার ৭১০ কোটি টাকা ভর্তুকি পেয়েছে। বিইআরসির কারিগরি কমিটি যে ৫৮ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে তা ভর্তুকি ছাড়া। আর বিশ্ববাজার থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে জ্বালানি তেল কিনে দেশে অপেক্ষাকৃত বেশি দামে বিক্রি করে গত ৭ বছরে বিপিসি বেশ মুনাফা করেছে। ওই সময়ে বিপিসিকে কোনো ভর্তুকি দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সংস্থাটি খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, সরকার বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে মোট ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখার জন্য গ্যাসের চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানিতে সরকারকে ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। বর্তমান বাজেটে ৮৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। প্রতি কিউবিক মিটার এলএনজি ক্রয়ে সরকারের ব্যয় ৫৯ দশমিক ৬০ টাকা। কিন্তু গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করা হয় মাত্র ৯ দশমিক ৬৯ টাকায়। সম্প্রতি তা ১১ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতি ইউনিটে উৎপাদন ব্যয় ১২ দশমিক ৮৪ টাকা কিলোওয়াট ঘণ্টা, কিন্তু এককপ্রতি পাইকারি মূল্য ৫ দশমিক ০৮ টাকা। ফার্নেস ওয়েলের প্রতি একক ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে ১৭ দশমিক ৪১ টাকা আর সরকার তা ৫ দশমিক ০৮ টাকায় দিচ্ছে। ডিজেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ৩৬ দশমিক ৮৫ টাকা, সেখানেও সরকার ৫ দশমিক ০৮ টাকা দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করছি। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ১২ দশমিক ৩৭ টাকা, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৫ দশমিক ০৮ টাকায়।
এদিকে ভতুর্কি প্রসঙ্গে বিপিসি সংশ্লিষ্টদের মতে, বিপিসির আর্থিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে এবং আর্থিক অবস্থা আরো খারাপ হতে যাচ্ছে। আর বিপিসির অর্থ মানেই সরকারের অর্থ। বিপিসি ইতোমধ্যে ভর্তুকি দিয়ে ফেলেছে। জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত উচ্চমূল্যের কারণে গত ৫ মাসে সংস্থাটির সব মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। সরকার ওই অর্থ এরইমধ্যে ভর্তুকি দিচ্ছে। বিপিসির অর্থ মানে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের অর্থ। সরকারের কাছ থেকে এখনো না নিলেও বিপিসির এ পর্যন্ত যা সামর্থ্য ছিল তা দিয়ে সরকারের পক্ষে ভর্তুকি দিয়েছে। তবে এ অবস্থা চলতে থাকলে নিজস্ব ব্যয় দিয়ে সংস্থাটির সামনে চলা কঠিন হয়ে যাবে। তখন সরকারের কাছে ভর্তুকি চাইতে হতে পারে।
অন্যদিকে ভর্তুকি প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলমের মতে, ভর্তুকি যা বরাদ্দ থাকে তার থেকেও বেশি দিতে হয়। এবারের গণশুনানিতে জ্বালানির মূল্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির হিসাবে ওই ভর্তুকি দাঁড়াচ্ছে ৫৮%, প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। মার্চেন পরে ওই পরিমাণ আরো বেড়েছে। তেলের দাম আরো বাড়ছে। আবার ভর্তুকি দেয়া হয়েছে কিন্তু খরচ হয়নি। যেমন এলএনজি খাতে সাড়ে ১০ হাজারে কোটি টাকার ওপরে ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই ভর্তুকি খরচ না হওয়ায় ২০১৯-২০, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি বেচে যায়। এলএনজি আমদানি করার কথা ছিল ৮ হাজার ৮৫০ এমএফসিএফডি কিন্তু আমদানি হয়েছে ৫০০ এমএফসিএফডির মতো। এলএনজির জন্য ভর্তুকি খরচ হয়নি। ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য সহনীয় রাখার জন্য ওই ভর্তুকি প্রদান করার কথা বলা হচ্ছে কিন্তু বিদ্যুৎ-জ্বালানি উৎপাদন হয়ে তা ভোক্তা পর্যায়ে আসতে নানা ভ্যালু এডেড কষ্ট যুক্ত হয়। আর তাতে যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে যুক্ত করা হয়। সেজন্য বিদ্যুৎ খাতে কম টাকার কাজ বেশি টাকা ব্যয়ে করানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাতে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বেড়ে যায়। আর ভর্তুকি দিয়ে ওই লুণ্ঠনমূলক ব্যয়কে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। মূলত সেবা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে বাঁচিয়ে রাখতেই ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, সারা বিশ্বে প্রচ-ভাবে খোলাবাজারে তেলের চাহিদা বেড়ে গেছে। খোলাবাজারে যে গ্যাস ছিল ৪ ডলার, তা হয়েছে ৩০ ডলার। তা কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অর্থ জোগান দিতে প্রচ-ভাবে বেগ পেতে হচ্ছে। সরকারের ভর্তুকি দিয়েও ওই পরিমাণ অর্থের জোগান দেয়া সম্ভব হবে না। আর সরকার যদি মূল্যবৃদ্ধিই করতে থাকে তাহলে সাধারণ জনগণের ওপর প্রচ-ভাবে চাপ সৃষ্টি হবে। সেজন্যটি সবকিছু ভেবেই নিতে হচ্ছে সিদ্ধান্ত।