নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে কাক্সিক্ষত মাত্রায় বিদেশী বিনিয়োগ আসছে না। এর কারণ হিসেবে ইউটিলিটি সেবা নিশ্চিত করতে না পারাকে দায়ী করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এখন পর্যন্ত দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় সরাসরি বা প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে মাত্র ৪৫ লাখ ডলার। মূলত ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। ওই অর্থবছরে অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিট এফডিআই প্রবাহ এসেছে সাড়ে ৩ লাখ ডলার। এরপর গত অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে নিট এফডিআই প্রবাহ আসে ২১ লাখ ২০ হাজার ডলার। এর পরের প্রান্তিক জানুয়ারি-মার্চে এসেছে ২০ লাখ ৩০ হাজার ডলার। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় নিট এফডিআই প্রবাহ এসেছে ৪৫ লাখ ডলার। বর্তমানে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় দেশী বিনিয়োগকারীরা সাড়া দিলেও কাক্সিক্ষত মাত্রায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। বেজা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রতিষ্ঠা হয়। আর সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করতে সংস্থাটির সময় লেগে যায় আরো চার বছর। এর পরের আট বছরে কাক্সিক্ষত মাত্রায় বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারেনি বেজার অধীন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো। যদিও সরকার দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে পরিকল্পিত ও বিশেষায়িত শিল্প অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে ওসব অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন, ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনার ভিত্তি থেকে বেজাকে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
এজন্য ২০১০ সালে একটি আইন প্রণয়ন হয়। আর ওই আইনের ভিত্তিতে পরের বছরের নভেম্বরে যাত্রা করে বেজা। শুরু থেকেই সংস্থাটিকে নানা বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সীমিতসংখ্যক কর্মীবাহিনী নিয়ে সংস্থাটির সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম শুরু করতে সময় লেগে যায় ২০১৫ সাল। বর্তমানে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় ইউটিলিটি সেবা নিশ্চিতে বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যা সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদন পেলেই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ইউটিলিটি সেবা নিশ্চিত করা যাবে। সূত্র জানায়, সরকারের পরিকল্পিত শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহ, কর্মসংস্থান ও শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রয়েছে।
আর তার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৯৭টির অনুমোদন হয়েছে। অনুমোদিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে ৬৮টি সরকারি ও ২৯টি বেসরকারি। এর মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হয়ে এখন পর্যন্ত উৎপাদনে যেতে পেরেছে ১১টি অর্থনৈতিক অঞ্চল আর নির্মাণাধীন রয়েছে ২৯টি। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় এ মুহূর্তে উৎপাদনরত কারখানা আছে ৪২টি। ওসব কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষের। তাছাড়া নির্মীয়মাণ শিল্প-কারখানার সংখ্যা ৫০টি। এখন পর্যন্ত বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় মোট বিনিয়োগ হয়েছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার। এর ৯৯ শতাংশের বেশিই দেশী বিনিয়োগ।
এ ছাড়া সরকারি পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ২৩ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন (২ হাজার ৩৯৭ কোটি) ডলার। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় দেশী-বিদেশী মোট প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ২৮ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন (২ হাজার ৮৪৭ কোটি) ডলার। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিপুল পরিমাণ প্রস্তাবিত বিনিয়োগ হলেও প্রকৃত বিনিয়োগ এসেছে খুবই নগণ্য। মূলত অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা, উন্নয়ন কর্মকান্ডে ধীরগতি ও কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশের ঘাটতির কারণে প্রকৃত বিনিয়োগ কম। তবে সামনের দিনগুলোয় অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় স্থানীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগের মাত্রা বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছেন বেজাসংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া জাপান, ভারত ও চীনের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রমও কম-বেশি এগিয়েছে। সূত্র জানায়, সার্বিকভাবে দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর অগ্রগতি নিয়ে বিদ্যমান বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অসন্তোষ রয়েছে। কারণ ধীরগতিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো। পাশাপাশি উদ্যোক্তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না। দেশে বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)। মোট ৩৫টি দেশের বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিত্ব করছে সংগঠনটি। দেশে মোট এফডিআই প্রবাহের ৯০ শতাংশই এসেছে এফআইসিসিআইয়ের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে।
ব্যাংক ও আর্থিক খাত থেকে শুরু করে সিমেন্ট, সিরামিক, কেমিক্যাল, নির্মাণ ও আবাসন, পরামর্শ, এফএফসিজি, গ্যাস-বিদ্যুৎ, চামড়া ও চামড়াজাত, পোশাক, পরিবহনের মতো খাতগুলোয় বিনিয়োগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর। সংগঠনটির পক্ষ থেকে দেশে বাস্তবায়নাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর উন্নয়ন সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ বলা হয়, বাংলাদেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো স্থাপন হচ্ছে ধীরগতিতে। সরকার এখন পর্যন্ত ৯৭টি জোনের অনুমোদন দিয়েছে, যদিও এর মধ্যে পুরোপুরি চালু হওয়া বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (এসইজেড) সংখ্যা খুবই কম। প্রস্তাবিত অঞ্চলগুলোর বেশির ভাগই সম্ভাব্যতা যাচাই, জমি অধিগ্রহণ ও অঞ্চলভিত্তিক সামাজিক এবং পরিবেশগত প্রভাব চিহ্নিত করার পর্যায়ে রয়েছে।
অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে জমিস্বল্পতা ও জটিল জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। এদিকে বেজায় বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিদের মতে, কোনো একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলকেও যদি সফল ও কার্যকর হিসেবে দেখানো সম্ভব হতো, তাহলে এগুলোকে সব বিনিয়োগকারীর জন্যই বিনিয়োগ গন্তব্য ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সামনে তুলে ধরা সম্ভব হতো। আবার অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে প্রথম ধাপের অবকাঠামো উন্নয়নের গতিও অনেকটাই শ্লথ হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট আইনগুলোরও আরো অনেক স্বচ্ছতা প্রয়োজন। পরিষেবা মূল্য নিয়েও প্রশ্ন আছে। পানিসংক্রান্ত নীতির বিষয়েও স্পষ্টতার প্রয়োজন আছে। তবে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো আশাবাদী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সংগঠন এফআইসিসিআইয়ের প্রতিনিধিরা।
সংগঠনটির সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় জানান, সরকারের ১০০ এসইজেড বাস্তবায়নে আমাদের পূর্ণ সমর্থন আছে। এটি বাস্তবায়ন হলে প্রথমত আমাদের সীমিত ভূমির দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত হবে। দ্বিতীয়ত, লক্ষ্যভিত্তিক অবকাঠামো নির্মাণের কারণে উৎপাদনশীলতাও বাড়বে। একই সঙ্গে অর্জন হবে কমপ্লায়েন্স মানও। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্সে ভূমির সীমাবদ্ধতা বা ইউটিলিটি সংযোগের মতো যেসব দুর্বলতার কথা উঠে এসেছে, সেগুলোও দূর করা যাবে।
অন্যদিকে বেজার বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কভিডকালেও বেজায় উল্লেখযোগ্য বিদেশী বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। এসব প্রস্তাব দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্যের বার্জার পেইন্টস, চীনের জিয়াংসু ইয়াবাং ডাইস্টাফ, জাইহং মেডিকেল প্রডাক্টস, সিসিইসিসি বাংলাদেশ লিমিটেড, অস্ট্রেলিয়ার এইচএ টেক লিমিটেড, রামকি এনভায়রো সার্ভিসেস, জার্মানির সঙ্গে যৌথ অংশীদারত্বে ভারতের ফরটিস গ্রুপ, নেদারল্যান্ডসের লিজার্ড স্পোর্টস এবং সিঙ্গাপুরের ইন্ট্রা-এশিয়া গ্রুপ। এ প্রসঙ্গে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন জানান, একটি কারখানা গড়ে তুলতে প্রচুর সময় লাগে।
তার পরও অল্প সময়ের মধ্যে সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল মিরসরাইয়ে ছয়টি, শ্রীহট্টতে দুটি বিদেশী উদ্যোগ পাওয়া গেছে। দ্রুতই আরো তিন থেকে চারটি প্রকল্প চালু হবে। এ ছাড়া বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলেও বিদেশী উদ্যোগে শিল্প প্রকল্প রয়েছে। এগুলো কোনোভাবেই কম অর্জন না। একটা শিল্পাঞ্চল তৈরি করতে প্রচুর সময় লাগে। ইকোনমিক জোনের ধারণাটির কেন্দ্রে ছিল স্থানীয় ও বিদেশী দুই ক্ষেত্র থেকেই বিনিয়োগ আকর্ষণ। এ ক্ষেত্রে কোনো অগ্রাধিকারের বিষয় নেই।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি