April 20, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, January 17th, 2023, 9:33 pm

দেশের ধান-চালের বাজারে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সরকার

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশের প্রধান খাদ্য ধান-চালের বাজারে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সরকার। আর দেশের খাদ্যের বাজারে শক্তিশালী হচ্ছে সক্রিয় অসাধু চক্র। কর্পোরেট ব্যবসায়ী, মিল মালিক ও মজুদদারদের কারসাজিতেই বাম্পার ফলনের পরও চালের বাজার অস্থির। সরকার কিছুতেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বরং ক্রমাগত চালের দাম বেড়েই চলেছে। সরকার ধান-চাল সংগ্রহেও আশার আলো নেই। সরকার যদি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারে কিংবা সরকারের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ না থাকে তখন ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দাম বাড়াবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অতি মুনাফার লোভী চক্রের কারণে দেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ এবং ধান-চাল খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার উৎপাদন বাড়ানো ও মজুদ বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকারি মজুদ বাড়াতে চাল আমদানি বাড়ানো হচ্ছে। এবার ৮ লাখ টন ধান-চাল অভ্যন্তরীণ বাজার থেকেও সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আমনের বাম্পার ফলনেও সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ খুবই কম। ধান-চাল সংগ্রহে রীতিমতো খাবি খাচ্ছে খাদ্য অধিদপ্তর। কারণ স্থানীয় বাজারে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ধানের মূল্য বেশি। ফলে কৃষকরা গুদামে ধান বিক্রি করতে যাচ্ছে না। খাদ্য বিভাগ গুদামে ধান বিক্রিতে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে মাইকিং, পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করেও সাড়া পাচ্ছে না। চলতি মৌসুমে ১৭ নভেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধান কেনা চলবে। লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ টন ধান কেনা। কিন্তু ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে ৩শ’ টন সংগ্রহ হয়েছে। মিল মালিক, মজুদদার ও কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের দখলে ধানের বাজার।
সূত্র জানায়, সরকারের সঙ্গে বরাবরই মিল মালিকরা চুক্তি করলেও চাল দেয়ার ঘটনা ঘটছে। আর মিল মালিকদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ায় তারা বেপরোয়া। তাদের কারণে বারবার বাজারে চাল সরবরাহে ভাঁটা পড়ায় চালের দাম আরো বাড়ছে। মিল মালিকদের লক্ষ্য হাতে চালের মজুদ রেখে দাম বাড়ানো। সরকার মজুদ পর্যাপ্ত করতে না পারলে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে খাদ্যসঙ্কট তৈরি করতে পারে। ইতোমধ্যে সরকার এবার ১৭ নভেম্বর থেকে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমন মৌসুমের (২০২২-২৩) ধান-চাল সংগ্রহের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। এ সময়ে সরকারের ৫ লাখ টন চাল ও ৩ লাখ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কিন্তু গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ টনের মধ্যে ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৩০০ টন। সরকারের গুদামে ধান দিচ্ছে না কৃষক। আর অনেক মিল মালিকও সরকারের সঙ্গে চাল দেয়ার চুক্তি করেনি। আর যারা চাল দেয়ার চুক্তি করেছে তারাও চাল দিচ্ছে না। অনেক মিল মালিকই নানান অজুহাতে চাল দিতে চুক্তির আওতায়ই আসেনি।
সূত্র আরো জানায়, এখন মজুদদারী ব্যবসাই অধিক লাভজনক। দেশের বাজারে মজুদকৃত পণ্যের লাভ ছাড়া ক্ষতির আশঙ্কা নেই। আবার মজুদের মাল কিনতেও নিজের টাকার প্রয়োজন হয় না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ট্রেডিং ব্যবসার ওপর কোটি কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। ওসব ঋণের টাকাই ধান, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য মজুদে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমন, বোরো, ভুট্টা ক্ষেত থেকে উঠার আগেই পণ্য কিনে করে গুদামজাত করার প্রস্তুতি থাকে। গ্রামাঞ্চলে বড় বড় গোডাউন তৈরি করে জামানত হিসাবে জমি ও গোডাউন ব্যাংকে বন্ধক রেখেই কোটি কোটি টাকা ঋণ মিলছে। তাতে ব্যাংকগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। আর ব্যবসায়ীয়া গোডাউন, জমি বন্ধক রেখে প্রাপ্ত ঋণের টাকায় ধানসহ উৎপাদিত পণ্যক্রয় করে গুদামে রাখছে। ৬ থেকে ৮ মাসের মধ্যে পণ্যের দাম বেড়ে গেলেই তা চড়া দামে বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা সুদসহ পরিশোধ করছে। ব্যাংকের সহযোগিতায় মজুদীকরণ ব্যবসা এখন অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ঝুঁকিছাড়া মজুদ ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় অনেকেই মিল বন্ধ রেখে মালামাল মজুদ করছে। মজুদ আইনে সরকারি তদারকি না থাকা এবং স্থানীয় প্রশাসননের নিরবতা মজুদদাররা আরো বেশি উৎসাহিত হচ্ছে।
এদিকে মিল মালিকদের মতে, সরকার নির্ধারিত ধান-চালের দাম বাজারের চেয়েও কম। সরকারকে ধান-চাল সরবরাহে লোকসান গুনতে হয়। সরকার এবার প্রতি কেজি চাল ৪২ টাকা আর ধান ২৮ টাকায় কিনছে। আর বাজারে চালের সর্বনিম্ন মূল্য ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা। একই কারণে কৃষকও ধান দিচ্ছে না। কৃষকরা স্থানীয় বাজারেই ধান বিক্রি করছে। সরকারি গুদামে ধান বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু প্রক্রিয়াগত জটিলতাও রয়েছে। খেসারত হিসাবে চলতি মৌসুমে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহে কোনো আশার আলো নেই।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনার সুযোগে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে একেবারেই জিম্মি সরকার। বিভিন্ন নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চালের বাজার। ব্যবসায়ীরা ধান কিনে যেভাবে মজুদ করছে। সরকারের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ না থাকার সুযোগে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বৃদ্ধি করবে। এমনকি অধিক মুনাফার জন্য তখন কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কট তৈরি করতে পারে। এমনিতেই করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছে। জাতিসংঘও এ বছর বিশ্বে ভয়াবহ খাদ্যসঙ্কটের আশঙ্কা করছে। ইতোমধ্যে দেশে এক শ্রেনির অসাধু ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার লোভে এখন ধান-চাল মজুদ শুরু করেছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের বিরুদ্ধেই ধান-চাল মজুদ করার অভিযোগ রয়েছে এবং অভিযোগে ভিত্তিতে মামলাও হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে অস্থির চালের বাজারে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। কিন্তু কারোর বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় অনেকেই আবার মজুদদারি করছে। সারাদেশে চালকল মালিক ও অন্যান্য ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিকভাবে ধান-চাল মজুদ করছে। যা খুবই আশঙ্কার বিষয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম খাদ্যসঙ্কট তৈরী করে দেশকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিতে পারে।