নিজস্ব প্রতিবেদক:
তলদেশে পলিথিনের স্তর দেশের নদীগুলোর মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের শহর এলাকার নদ-নদীগুলোই সবচেয়ে বেশি পলিথিন দূষণের শিকার হচ্ছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ^রী নদী; বরিশালের কীর্তনখোলা নদী; চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর পড়েছে। তাছাড়া নরসুন্দা, নবগঙ্গা, সুরমা, করতোয়া, ইছামতিসহ বিভিন্ন নদ-নদীতেও পলিথিন দূষণ রয়েছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, হালদা ও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে কয়েক ফুট পুরু পলিথিনের স্তর জমার কারণে নদীর দূষণ ছাড়াও ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্যও। পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণে হুমকির মুখে পড়ছে মাছের জীবনচক্র। পরিবেশবিদরা বলছেন, নদীর তলদেশ থেকে প্লাস্টিক ও পলিথিন মুক্ত করা না যায় তাহলে দেশের অনেক শহরেই বন্যার সময় পানি উঠবে। পরিবেশবিদ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী। কিন্তু বর্তমানে সামান্য বৃষ্টি হলেই দেশের নদ-নদীগুলো উপচে পানি আশপাশের বাড়ি-ঘর ক্ষেত খামার ভাসিয়ে দিচ্ছে। সিলেটের সুরমা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর জমায় নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বেশির ভাগ নদীর একই অবস্থা। দেশের প্রায় সব নদ-নদীতে পলিথিন-প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব থাকলেও সিটি করর্পোরেশন, জেলা শহর, পৌরসভা ও উপজেলা শহর এলাকা দিয়ে বয়ে চলা নদীতে পলিথিন সবচেয়ে বেশি পলিথিনের স্তর দেখা যায়।
সূত্র জানায়, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়। দেশে ব্যবহৃত একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিকের স্ট্র, কটনবাড, ফুড প্যাকেজিং, ফুড কনটেইনার, বোতল, প্লেট, প্লাস্টিক চামচ, প্লাস্টিক, ব্যাগ, পেস্ট, শ্যাম্পুর প্যাকেট ইত্যাদি। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে ওসব প্লাস্টিক কৃষি জমি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নদী-নালা, খাল-বিল ও সমুদ্রে পতিত হয়ে প্রতিবেশ ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি করছে। পরিবেশ অধিদফতরের মতে, পলিথিনসহ হিসাব করলে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১০ লাখ ৯৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। আর নিষিদ্ধ পলিথিন প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি নদীর তলদেশে জমা হচ্ছে। তাতে নদী ও নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। অথচ দেশে পলিথিন উৎপাদন নিষিদ্ধ। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ২০০২ এ পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয়। আইনে বলা হয়েছে, ‘সরকার নির্ধারিত পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণে প্রথম অপরাধের দায়ে অনধিক ২ (দুই) বছরের কারাদ- বা অনধিক ২ (দুই) লাখ টাকা অর্থদ- (জরিমানা) বা উভয় দ- এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছরের কারাদ- বা অন্যূন ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদ- (জরিমানা) বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন অপরাধীরা’। ‘বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের দায়ে অনধিক ১ (এক) বছরের কারাদ- বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদ- (জরিমানা) বা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে’। আইন করে পলিথিন নিষিদ্ধ হলেও এর উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার থেমে নেই। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিন কোটি কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। আর ফেলে দেওয়া পলিথিন ব্যাগের একটা বিরাট অংশ কোনো না কোনোভাবে নদীতে গিয়ে পড়ছে। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর জমেছে।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবল বর্ষণে আন্তঃসীমান্ত সব নদী দিয়ে প্রবল বেগে পাহাড়ি ঢল নামছে। ওই ঢলের সঙ্গে আসছে হাজার হাজার টন মাটি ও বালু। যে কারণে আকস্মিক বন্যার মুখোমুখি সিলেট ও সুনামগঞ্জের মানুষ। সিলেট নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ২৬টি ছোট-বড় পাহাড়ি ছড়া (প্রাকৃতিক খাল) ও খাল দিয়ে দৈনিক অর্ধশত টন পলিথিন ও প্লাস্টিকযুক্ত বর্জ্য সুরমা নদীতে গিয়ে মেশে। তাতে সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। আর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় সুরমা নদীর পানি উপচে ঢলের পানি নগরে ঢুকেছে। গত কয়েক দশকে সিলেটের বড় দুই নদী সুরমা, কুশিয়ারাসহ সব নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পড়েছে। শুকনো মৌসুমে নদীতে বড় বড় চর জাগে। অসংখ্য নদী মরে গেছে। শুধু সিলেট নয়, সারা দেশের নদ-নদীর একই চিত্র। রাজধানী বুড়িগঙ্গার নদীর দুই পাড়ে ময়লার ভাগাড়। যেসব ময়লার মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক, প্লাস্টিকের প্যাকেট, বোতল ও পলিথিনের ব্যাগ। আশপাশের বাসিন্দা ও দোকানিদের সমস্ত ময়লা প্রতিদিন নিয়ম করে ওই নদীতে ফেলা হচ্ছে। আর ওসব বর্জ্য দিয়ে নদীকে এমনভাবে ভরে আছে যে কোনো দিকে আর পানি চলাচলের অবস্থা নেই। নদ-নদীর তলদেশ ভরাট করা প্লাস্টিকের ২২ ভাগ ব্যবহার হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে এবং ৭৮ ভাগ শহরে ব্যবহার হচ্ছে। তবে ফুড প্যাকেজিং খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মধ্যে রয়েছে। বছরে প্রায় ৫৪ হাজার প্যাকেট বর্জ্য হিসাবে আসছে। তারপরই রয়েছে কটনবাড, শ্যাম্পু, পেস্টের টিউব এবং স্ট্র। ওসব পণ্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে রেস্টুরেন্ট, হোটেল, এয়ারলাইন্স, সুপারশপ ও কমোডিটি পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। পলিথিন বন্ধে কঠোর আইন রয়েছে কিন্তু সে আইনের প্রয়োগ নেই। পরিবেশবিদরা জানান, ২০০২ সালে পলিথিন বন্ধে আইন পাস করার পর পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পরবর্তীতে ওই কঠোরতা আর থাকেনি।
এদিকে পরিবেশবিদদের মতে, বাংলাদেশের মানুষ কৃষিকাজের উপরই বেশি নির্ভরশীল। কৃষিকাজ, মানুষের জীবনযাপন ও অর্থনীতির সঙ্গে নদ-নদীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সারা দেশে নদীর পানিতে হাজার হাজার একর জমিতে ধানসহ নিভিন্ন ধরণের ফসল ফলানো হয়। কিন্তু তলদেশে প্লাস্টিক ও পালিথিনের স্তর জমে যাওয়ায় নদ-নদী পানি ধরে রাখতে পারছে না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে পানি উঠলে পড়লেও অন্য সময় শুকিয়ে যায়। তাতে কৃষক জমিতে চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পায় না। দেশের ওই নদ-নদী যদি পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণ অব্যাহত থাকলে তা পুরো অর্থনীতির জন্য অশনি সঙ্কেত।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ