October 5, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, July 5th, 2023, 7:46 pm

দেশের পাচারকৃত অর্থ যাচ্ছে নতুন গন্তব্যে

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ যে দেশগুলোর ব্যাংকে রাখা হয়েছিল তা এখন অন্য দেশগুলোতে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। অর্থপাচারের নেপথ্যে যেসব কারণ বিদ্যমান তা হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কালোটাকা দেশে সহজে ভোগ করতে পারেন না। এজন্য তারা বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোমও গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। ধর্নাঢ্য বাংলাদেশী ও অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের মালিকরা এখন আর আগের জায়গায় অর্থ রাখা নিরাপদ মনে করছেন না। কোন কোন দেশে অর্থ পাচার হয় বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থার অনুসন্ধানে জানা গেলেও কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তার সঠিক কোনো হিসাব জানা যায়নি। টাকা পাচারকারীদের প্রিয় গন্তব্য এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর। টাকা পাচারের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সুইস ব্যাংকগুলোর নাম শোনা গেলেও পাচার করা টাকার মাত্র ৫ শতাংশ জমা হয় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে।

সুইজারল্যান্ডের সুইস ব্যাংক ছিল পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য। বাংলাদেশসহ  বিশ্বের কর ফাঁকি ও অবৈধভাবে পাচারকৃত অর্থ জমা হতো সুইস ব্যাংকগুলোতে। আর্থিক লেনদেনে তারা সংরক্ষণ করতো কঠোর গোপনীয়তা। সুইস ব্যাংকের প্রশ্রয়মূলক নীতি এখন বিশ্বে তীব্র সমালোচনার মুখে। ফলে সুইজারল্যান্ড সরকার লেনদেনে কড়াকড়ি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের চেষ্টা করছে। এ কারণে সুইস ব্যাংক এখন প্রতিবছর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য প্রকাশে বাধ্য হচ্ছে। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থ পাচারের তথ্য আদান-প্রদান করছে। তাই সুইস ব্যাংক এখন আর অর্থ পাচারকারীদের তেমন ভরসায় নেই। এখন টাকা পাচারের বেশি অর্থ যায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও কাতারে। তবে জানা গেছে যে, পাচারকৃত অর্থ সরিয়ে নেয়া হচ্ছে নতুন গন্তব্যে।

নতুন গন্তব্যের মধ্যে মিসর, গ্রিস, জার্মানি ও ব্রাজিলের নাম আসছে সামনে। এছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকাও এ তালিকায় রয়েছে বলে জানা যায়। প্রাথমিকভাবে গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, বিদেশে সম্পদ গড়া ব্যক্তিদের মধ্যে শীর্ষে আছেন আমলারা। স্ত্রী সন্তানসহ অনেকের পাসপোর্টে দীর্ঘ মেয়াদের আমেরিকার ভিসা লাগানো আছে। বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য আছেন এর মধ্যে। সব ধরনের ব্যবস্থা তারা করে রেখেছেন। সরকার কোন রকম বেকায়দায় পরলে তারা পাড়ি জমাবেন সেখানে। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, আমলাদের মধ্যে যারা আমেরিকায় সম্পদ করেছেন তাদের অনেকেই গত ১০-১২ বছরে সরকারের ঘনিষ্ঠ সেজে সম্পদ করেছেন। এদের অনেকেই সরকার বদল হলে নিজের অবস্থানও বদলে ফেলবেন। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা-নীতিতে বিচলিত তারা। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ (জিএফআই) জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হয়। টাকা পাচারের ঘটনা শুধু এই সরকারের আমলেই ঘটেছে, তাই নয়।

বিগত সরকারগুলোর সময়েও ঘটেছে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বা প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। শুধু সুইস ব্যাংকেই বাংলাদেশীদের টাকা জমা রয়েছে ৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অর্থপাচারের অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে নাম আসা ৬৯ জনের একাটি তালিকা হাইকোর্টে দাখিল করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তালিকায় অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত পানামা পেপার্সে নাম আসা ৪৩ জন এবং প্যারাডাইস পেপার্সে আসা ২৬ জন ব্যক্তির নাম, ঠিকানা ও আংশিক পরিচয় তুলে ধরা হয়। দুদকও আলাদাভাবে পানামা পেপার্স ও প্যারাডাইস পেপার্সে আসাদের নাম হাইকোর্টে দাখিল করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালের তুলনায় এর পরিমাণ প্রায় ৫৭৩ গুণ বেশি; ২০৪১ সাল নাগাদ এর পরিমাণ আরো বাড়বে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমদানি পণ্যের দাম ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেখানোর ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংকিং ও কাস্টমস পরিভাষায় এ বাড়িয়ে দেখানোর নাম ‘ওভার ইনভয়েসিং’।

বাংলাদেশের অর্থ পাচারের বেশির ভাগ সংঘটিত হয় আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে ‘মিস ইনভয়েসিং’ বা চালান জালিয়াতির মাধ্যমে। এর ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক কর ফাঁকি সংঘটিত হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে এতে জানা গেছে এক বছরের ব্যবধানে ৯৪ শতাংশ অর্থ তুলে নিয়েছে বাংলাদেশীরা। যা ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বাংলাদেশী মুদ্রায়। এত দ্রুত এই অর্থ কোথায় গেল তা অনেকের কাছেই আগ্রহের বিষয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চাইলেই এখন যেকোনো দেশে টাকা নিয়ে যাওয়া সম্ভব। দেশের অর্থ পাচার করা এখন অনেকের কাছে সহজ। বিশ্বেও অনেক দেশেই টাকা পাচার হচ্ছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও হুন্ডির মাধ্যমে। এ বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত উল্লেখযোগ্য হারে কমার কারণ এবং কারা এই আমানত তুলে নিচ্ছে- তা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে। কারণ, সুইস ব্যাংকের আমানতদার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম জানানো হয় না। শুধুমাত্র দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন দেশ থেকে জমা হওয়া অর্থের হিসাব তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে থাকে।