নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের শিল্প খাতে ক্রমশ তীব্র হচ্ছে উৎপাদন সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা। ইতোমধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের গতি মন্থর হওয়ার কারণে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য হারে কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং কমে গেছে। কমেছে আন্তর্জাতিক জাহাজ আসার সংখ্যাও। চলতি বছরের নয় মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বন্দরে (প্রতিটি ২০ ফুট দীর্ঘ হিসেবে) কনটেইনার হ্যান্ডলিং কমেছে ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সংকট পরিস্থিতিতেও কার্গোর প্রবৃদ্ধি বজায় থাকলেও এবার তার ব্যত্যয় ঘটেছে।
এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পণ্যবাহী জাহাজের সংখ্যা কমেছে ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। মূলত ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খুলতে না পারায় ব্যবসা-বাণিজ্যে যে ধাক্কা লেগেছে, তারই প্রতিফলন দেখা গেছে বন্দরের পরিচালন কার্যক্রমে। এর মধ্যে নতুন করে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে বলে জানিয়েছেন উৎপাদন খাতে যুক্ত শিল্পোদ্যোক্তারা। তাদের মতে, ইস্পাত, সিমেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানার কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় এসব খাতে ৩০ শতাংশেরও বেশি উৎপাদন কমে গেছে। শিল্পের কাঁচামালসহ প্রায় সব ধরনের আমদানি কমায় ফাঁকা থাকছে বন্দরের জেটিগুলো। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে উৎপাদন আরো সংকুচিত হতে পারে। শিল্পোদ্যোক্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ব্যবসা পরিচালনা এমনিতেই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ডলার সংকটে বন্দরের আমদানি পরিচালনচিত্রে তারই প্রতিফলন হয়েছে। হুন্ডিসহ অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো ভালো উদাহরণ তৈরি করেছে। এদেশেও পণ্য রপ্তানি হওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রপ্তানি আয় দেশে আনার বাধ্যবাধকতা কার্যকরসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আর তা বাস্তবায়ন হলে সংকট নিরসনে বড় ভূমিকা রাখবে। রপ্তানি আয় বাড়াতেই হবে। বাস্তবতার নিরিখে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে উঠে আসা কথা বা সুপারিশগুলো অ্যাড্রেস করার পাশাপাশি উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ধরে রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকাটা খুবই জরুরি। সূত্র জানায়, দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভার অনেকটাই এককভাবে বহন করে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দর।
সমুদ্রপথে পণ্যের ৯৩ শতাংশই আমদানি-রপ্তানি হয় এ বন্দর ব্যবহার করে। এর মধ্যে কনটেইনার পরিবহনে ৯৮ শতাংশ পণ্যই ওঠানো-নামানো (হ্যান্ডলিং) হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। এর উল্লেখযোগ্য অংশই শিল্পপণ্য। কনটেইনারবাহী জাহাজ ও খোলা পণ্যবাহী বাল্ক কার্গো দুই ধরনের জাহাজে আসা পণ্য ওঠানামার ভিত্তিতে বন্দরের প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষেত্রে পণ্য হ্যান্ডলিং গড়ে ১২-১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধিকেই আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। চলতি বছরের নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বার) ২২ লাখ ৮৭ হাজার টিইইউ (টোয়েন্টি ফিট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিটস) কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। গত বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ ১৬ হাজার টিইইউ। ওঠানামার এ হিসাবে বন্দরটির মূল ইয়ার্ডের সঙ্গে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) ও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনালের (আইসিটি) পণ্যভর্তি ও খালি কনটেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমও যুক্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে খোলা পণ্য (কার্গো হ্যান্ডলিং) পরিবহনের প্রবৃদ্ধি সাধারণত সংকটময় পরিস্থিতিতেও বজায় থাকে।
যদিও এবার তার ব্যত্যয় ঘটেছে। কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের নয় মাসে ৯ কোটি ৪ লাখ ৭৮ হাজার টন কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে। গত বছর একই সময়ে এটি ছিল ৯ কোটি ১২ লাখ ৮৮ হাজার টন। বাল্ক কার্গোর এ হিসেবে কনটেইনার কার্গোও যুক্ত করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক অবস্থা এখন যে পর্যায়ে তার সঙ্গে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিও যদি অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যায়, তাহলে এটা ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনার জন্য খুবই নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করবে। চাহিদা অনুযায়ী ডলার না পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে আমদানি কমে বন্দরে এর প্রভাব পড়েছে। যাদের ইন্ডাস্ট্রি আছে সবারই ব্যাংকের লায়াবিলিটিজ আছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যখন রেভিনিউ কমতে থাকে তখন স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য কষ্ট কাটিং স্টেপগুলো নেয়ার বিষয়টি সামনে আসে। এর সঙ্গেই কর্মসংস্থানের বিষয়টি জড়িত।
শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমলে উৎপাদনও কমে আসে। আবার উৎপাদনের সঙ্গে কর্মসংস্থান ও শিল্পের প্রবৃদ্ধি সরাসরি জড়িত। বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়িয়েও অনেক উদ্যোক্তা পরিকল্পনা অনুযায়ী উৎপাদন ধরে রাখতে পারছেন না। কাঁচামাল আমদানিতে এখনো ডলার সংকটসহ নানা কারণে উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশই অব্যবহৃত থাকছে। সূত্র আরো জানায়, কভিড মহামারী থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা একটার পর একটা চ্যালেঞ্জ পার করে আসছেন। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে বহির্বিশ্ব থেকে বাল্ক আকারে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হতো তা ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ বেশি ছিল। বর্তমানে ২০২৩ সালের শুরু থেকেই এটি কমতে শুরু করে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্ব বিভাগও কিন্তু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রতুলতার কারণে নির্বাহী বিভাগ থেকে ব্যাংকে এলসি খোলার লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। যদি বাল্ক পণ্যের কথা বলা হয় দেখা যাবে এখানে সর্বোচ্চ আমদানিকারক সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা। এ নির্মাণপণ্যের কাঁচামাল চাহিদার তুলনায় আমদানি হচ্ছে ৭৫ শতাংশ, অর্থাৎ বাধ্য হয়েই প্রডাকশন মিনিমাইজ করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে। একদিকে বড় ধরনের এক্সচেঞ্জ লসে পুঁজি ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার ক্রমাগত অবমূল্যায়নের কারণে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বেশি প্রয়োজন হচ্ছে, যার জোগান ব্যাংকগুলো দিতে পারছে না। আবার উচ্চ সুদহার, অসামঞ্জস্যপূর্ণ কর ব্যবস্থাপনা, অল্প সময়ের ব্যবধানে জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
এখন নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা শিল্পোদ্যোক্তাদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। এভাবে যদি চলতে থাকলে উৎপাদন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে। সেই সঙ্গে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কর্ম হারানোর ভয়ও রয়েছে। ইতোমধ্যে আমদানি-রপ্তানি কমার প্রভাবে বদলে গেছে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আগমনের চিত্রও। চলতি বছরের নয় মাসে ৩ হাজার ১০৯টি আন্তর্জাতিক জাহাজে পণ্য এসেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। গত বছরের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ২৪৯। অর্থাৎ জাহাজের আগমন কমেছে ৪ শতাংশেরও বেশি।
ডলার সংকটে শিল্পের কাঁচামাল আনতেও ঋণপত্র খুলতে বাধার সম্মুখীন হওয়াসহ চতুর্মুখী চাপ সামাল দিয়েই কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম ধরে রাখতে হচ্ছে। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ে ডলার সংকট এখনো অব্যাহত রয়েছে। এরই প্রভাবে বন্দরে যেখানে জেটি খালি থাকত না, এখন উল্টো ফাঁকা থাকে। সরকারের রাজস্ব লক্ষ্য পূরণেও এর প্রভাব পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য যদি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে আরো বাধাগ্রস্ত হয়, এতে অর্থনৈতিক সংকট আরো গভীর হবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ