নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের অনেক অপরাধীই নির্ভুল ময়নাতদন্ত না হওয়ায় ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। মূলত আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ স্বল্পতা এবং ডোমদের আধুনিক কোনো প্রশিক্ষণ না থাকা পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিকভাবে ময়নাতদন্ত সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই চলছে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদের কাজ। মানা যাচ্ছে না বৈজ্ঞানিক নির্দেশিকা। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ছাড়া ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করায় মৃত্যুর প্রকৃত কারণও অজানা থেকে যাচ্ছে। রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে গতানুগতিক। তাতে পার পেয়ে যাচ্ছে অনেক অপরাধী। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতাল মর্গে পানি, ভেন্টিলেশন, পর্যাপ্ত আলো ও ব্যবহৃত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। মর্গে নেই ভিসেরা (দেহের অন্ত্রের ভেতরের অংশ) সংরক্ষণের ব্যবস্থাও। নমুনা রাখার কনটেইনার, প্রিজারভেটিভ ও রাসায়নিকেরও পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। নিম্নমানের রাসায়নিক দিয়ে মর্গগুলোতে নমুনা সংরক্ষণ করা হয়। আর অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা তো সেখানে স্বাভাবিক ব্যাপার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশে ময়নাতদন্ত এখনো আধুনিক রূপ পায়নি। ওই বিষয়ে কোনো আইন বা বিধিমালা করা হয়নি। ফলে ন্যায়বিচারের জন্য অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ অংশ ময়নাতদন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে না। সাধারণত দুদিনের মধ্যে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেয়াকে গ্রহণযোগ্য ধরা হলেও দেশে তার ব্যত্যয় ঘটছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ময়নাতদন্তে বিধিমালা ও গাইডলাইন করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, মাইক্রোবায়োলজি ও প্যাথলজির ল্যাবরেটরি ময়নাতদন্তের জন্য প্রয়োজন হয়। আর কখনো কখনো রাসায়নিক বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন পড়ে। তখন সিআইডি পুলিশের ফরেনসিক ল্যাবে নমুনা পাঠানো হয়। যা দেশের একমাত্র রাসায়নিক বিশ্লেষণের ল্যাবরেটরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মৃতদেহ কাটাকাটির জন্য অন্তত ২৪ ধরনের যন্ত্র প্রয়োজন। একই সঙ্গে জটিল ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এক্স-রে ও এমআরআই মেশিনের সাহায্য লাগে। কিন্তু দেশে মাত্র পাঁচ-সাত ধরনের যন্ত্র দিয়ে ময়নাতদন্ত করা হয়। পাশাপাশি যন্ত্র দিলেও তা ব্যবহারে পারদর্শী লোকবলের অভাব রয়েছে। তাছাড়া ময়নাতদন্তে চিকিৎসকের সহায়তাকারী ডোম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বংশপরম্পরায় এ পেশায় আসছে। তাদের কোনো আধুনিক প্রশিক্ষণ নেই।
সূত্র আরো জানায়, দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজে ফরেনসিক মেডিসিনে ১৯ জন অধ্যাপকের বিপরীতে রয়েছেন ৩ জন, ১৯ জনের বিপরীতে সহযোগী অধ্যাপক রয়েছেন ৮ জন ও ২৭ জন সহকারী অধ্যাপকের বিপরীতে রয়েছে মাত্র ১১ জন। ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে যারা প্রভাষক রয়েছেন তাদেরও বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রেষণে নিয়ে আসা। ফলে ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা তাদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে মনে করছেন না। সরকারি মেডিকেল কলেজে বেসিক সায়েন্সের এ বিভাগে ১৬৯টি পদের মধ্যে ৮৮টিই খালি রয়েছে। ফরেনসিক মেডিসিনে চিকিৎসকদের আগ্রহ কম। ময়নাতদন্তের পরবর্তী সময়ে আদালতে সাক্ষী দেয়ার জন্য হাজিরা ও প্রতিবেদন তৈরিতে চাপ থাকে। আইনি কারণে অনেক অবসরপ্রাপ্ত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞেরও নিয়মিতভাবে কর্মস্থল ও আদালতে হাজিরা দিতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে জেলা জেলা হাসপাতালগুলোতে ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ না থাকায় মেডিকেল অফিসারদেরই ময়নাতদন্ত করতে হয়। তাতে ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ সঠিক না হওয়ার শঙ্কাও থাকে। একই সঙ্গে ক্লিনিক্যাল ময়নাতদন্ত না হওয়ায় গবেষণার বিষয়ও পিছিয়ে থাকছে।
এদিকে মেডিকো লিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সূত্র মতে, যেসব স্থানের সরকারি মেডিকেল কলেজের মর্গ রয়েছে, সেসব জেলা হাসপাতালে মর্গ নেই। শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখানোর জন্য ওসব মর্গ মূলত কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অধীনে থাকে। যদিও দেশে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে মাত্র ১৮টিতে মর্গ রয়েছে। সেগুলো হলো ঢাকা মেডিকেল, চট্টগ্রাম মেডিকেল, রাজশাহী মেডিকেল, ময়মনসিংহ মেডিকেল, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল, শেরেবাংলা মেডিকেল, রংপুর মেডিকেল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল, কুমিল্লা মেডিকেল, খুলনা মেডিকেল, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল, এম আবদুর রহিম মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল, যশোর মেডিকেল, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল, জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিকেল, পাবনা মেডিকেল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ। মর্গ বলতে এক বা একাধিক কক্ষের ভবন, যেখানে মৃতদেহ সংরক্ষণ, রেফ্রিজারেটেড বডি স্টোরেজ সুবিধা, স্বজনদের মৃতদেহ দেখার জন্য আলাদা ব্যবস্থা, ময়নাতদন্তের জন্য ও শেষে দেহকে প্রস্তুত করার ঘর।
অন্যদিকে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা জানান, অল্প সময়ের জন্য মৃতদেহ সংরক্ষণের প্রয়োজন হলে তা ২ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের জন্য হলে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দেহকে সংরক্ষণ করতে হয়। তবে দেশের বেশির ভাগ মর্গেই মৃতদেহ সংরক্ষণের এমন ব্যবস্থা নেই। তার মধ্যে আবার বিকাল ৫টার পর দেশের কোথাও ময়নাতদন্ত করার বিধান নেই। মূলত দিনের আলোতেই কাজটি করার বিধান রয়েছে। ফলে বিকালের পর মর্গে আসা মৃতদেহকে সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজার জরুরি হলেও দেশের অনেক জেলায়ই তেমন ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া ময়নাতদন্তের জন্য মাইক্রোবায়োলজি ও প্যাথলজির ল্যাবরেটরি প্রয়োজন হয়। আর রাসায়নিক বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন পড়লে সিআইডি পুলিশের ফরেনসিক ল্যাবে নমুনা পাঠানো হয়।
এ প্রসঙ্গে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ডা. কামদা প্রসাদ সাহা জানান, মর্গের ভবন আধুনিক না হওয়ার কারণেই দেশে ময়নাতদন্তের দুরবস্থা। ফরেনসিক মেডিসিনে সুযোগ-সুবিধা না থাকায় চিকিৎসকরাও এখন আর এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে আগ্রহী হচ্ছে না। শুধু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবহেলিত থাকছে। ফরেনসিক মেডিসিন চিকিৎসকদের এ বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ