September 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, July 16th, 2023, 9:28 pm

দেশে মহামারীর পর্যায়ে ডেঙ্গু

বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমসিম খাচ্ছে। ছবিটি মুগদা হাসপাতাল থেকে তোলা।

নিজস্ব প্রতিবেদক:

জনস্বাস্থ্য সঙ্কট পর্যায়ে পৌঁছেছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। যখন কোনো অনিয়ন্ত্রিত রোগ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেটাকে মহামারি বলা যায়। আবার যখন একটা-দুটি এলাকায় থাকে তখন সেটাকে প্রাদুর্ভাব বলা হয়। সে হিসেবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারি পর্যায়ে চলে গেছে। বর্তমানে প্রতিদিন শত শত মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। পরিস্থিতি মহামারী পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন ও সমন্বিত পদক্ষেপের তাগিদ দিয়েছেন। সংজ্ঞা অনুযায়ী যদিও ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি মহামারি পর্যায় যায়নি। তবে এটি মহামারির কাছাকাছি। যদি আরো বেড়ে যায়, তাহলে এটাকে মহামারি বলা যাবে। মূলত রোগ সম্পর্কে যে ধারণা করা হয় তার চেয়ে যদি অনেক বেশি বেড়ে যায় তাহলে সেটাকে মহামারি পর্যায় বলা হয়। এবার ঢাকার বাইরে যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা মহামারিরই নামান্তর। আবার কোনো জায়গায় কখনো কারো ডেঙ্গু হয়নি, কিন্তু সেখানে যদি একটি লোকের ডেঙ্গু হয় তাহলেও সেটা মহামারি। এর বাইরে আরেকটা হলো, যদি কোনো একটা নিদিষ্ট জায়গায় গত পাঁচ বছরের তুলনায় গড়ে ডেঙ্গু অনেক বেশি হয় তাহলেও সেটিকেও মহামারি বলা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫ দশমিক ৪৫ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরিসংখ্যানে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী এ বছর বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। রোগটির বাহক এডিস মশা এরইমধ্যে আচরণ বদলে ফেলেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গুর লক্ষণেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের তীব্র জ¦রে আক্রান্ত হতেও দেখা যাচ্ছে কম। যদিও এর শক সিনড্রোম এখন আরো প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে। শনাক্তের আগেই মৃত্যুর ঘটনাও শোনা যাচ্ছে অনেক। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও হিসাব প্রকাশ করছে শুধু হাসপাতালে ভর্তিভিত্তিক। চলতি বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলতি বছরের মতো এত রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর ঘটনা আগের বছরগুলোয় দেখা যায়নি। এতোদিন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ রাজধানীতেই কেন্দ্রীভূত ছিল। এখন রাজধানীর বাইরে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে।

বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমসিম খাচ্ছে। ছবিটি মুগদা হাসপাতাল থেকে তোলা।

এ বছর রোগীরা চিকিৎসার আওতায় দেরিতে আসছে বলে মৃত্যুও বেশি হচ্ছে। কারণ রোগীরা শেষ মুহূর্তে চিকিৎসার আওতায় আসছে। আর যে রোগী ও মৃত্যু সংখ্যা জানা যাচ্ছে তা হাসপাতালভিত্তিক। এর বাইরে যেসব রোগী রয়েছে এবং মৃত্যু হচ্ছে তা হিসাবের বাইরে থাকছে। আগামীতে ডেঙ্গু আরো মারাত্মক হতে পারে। সারা দেশে ডেঙ্গু যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখাই কঠিন হবে। সূত্র জানায়, ডেঙ্গুতে মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য হলেও এ রোগ মৃত্যু বাড়ছে। সেজন্য ব্যবস্থাপনা বৈজ্ঞানিক হওয়া জরুরি। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং ইউনিয়নের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা ভালো হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। নারী, শিশু, গর্ভবতী, বয়োবৃদ্ধদের মধ্যে ডেঙ্গু শনাক্ত হলে তাদের যদি হাসপাতালে ভর্তির মতো অবস্থা না-ও হয়, তবুও তাদের পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। মশা, রোগী ও যে কীটনাশক দিয়ে মশা মারা হচ্ছে, এসব বিষয় নিয়ে দেশে সার্ভিল্যান্স বা বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণও জরুরি। কিন্তু এদেশে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নির্মূলে ও রোগী ব্যবস্থাপনায় জনস্বাস্থ্যের চিন্তা-ভাবনা উপেক্ষিত।

শুরু থেকেই সমন্বিত উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ একে অপরের প্রতি দোষারোপ করছে। রোগ দেখে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অথচ এ কার্যক্রম সারা বছরের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যেসব রোগীর হিসাব দিচ্ছে তা শুধু হাসপাতালে ভর্তিভিত্তিক। এর বাইরে যেসব রোগী বাড়িতে রয়েছেন এবং মারা যাচ্ছেন, তাদের হিসাব আসছে না। একই সঙ্গে বহু বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হলেও সেসব রোগীর তথ্যও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই। ফলে ডেঙ্গুর সরকারি হিসাব একপক্ষীয়।

সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০২১ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণের একটি নির্দেশিকা করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বরং সেটি কার্যকর করতে আন্ত মন্ত্রণালয় টাস্ক ফোর্স লাগবে। এ ছাড়া জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবার এগিয়ে আসতে হবে। জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলা করতে হয় একটা কারিগরি কমিটির মাধ্যমে। এটি এখন জরুরি। ঠিক যেমন কভিডের সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে এক ধরনের সমন্বিত কমিটি গঠনের মাধ্যমে মোকাবেলা করা হয়েছিল। এতে সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, কীটতত্ত্ববিদ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আর শুধু ঢাকা নয়, জেলা পর্যায়েও এখন মশা নিধন জরুরি। এ ক্ষেত্রে কোন জায়গায় রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হবে, কতটুকু ব্যবহার হবে, এ বিষয়টি পরামর্শ নিয়ে করতে হবে। এ ছাড়া জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা আরো জোরদার করতে হবে। যেহেতু ডেঙ্গুর ধরন বদলে গেছে, সুতরাং জেলা পর্যায়ে যাতে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালগুলোতে যেন রক্তের ব্যবস্থা থাকে, যাতে সহজে ও দ্রুত ডেঙ্গু পরীক্ষা করা যায়। একই সঙ্গে জটিল রোগী সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা থাকতে হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে আগামী এক মাস ডেঙ্গুর যেকোনো পরীক্ষার ফি ৫০ টাকা নির্ধারণ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ইতোমধ্যে দেশের সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, সিভিল সার্জন এবং সব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের এ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর এনএসওয়ান, আইজিজি এবং আইজিএম পরীক্ষা করতে ১০০ টাকা দিতে হতো। রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার সুবিধার্থে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের সব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের পরীক্ষার ফি ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি ৩০০ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। এটি গত বছর থেকে চলমান। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম জানান, হাসপাতালে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এর বাইরেও রোগী ও রোগ ব্যবস্থাপনাও করা হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা চলছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ চলছে।