নিজস্ব প্রতিবেদক:
ধান চাষে কৃষকদের কাছে ক্রমেই হাইব্রিড জাতগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশে বিগত ১৯৯৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে হাইব্রিড জাতের ধান চাষ শুরু হলেও বিগত ৫ বছরে আবাদের পরিধি অনেকে বেড়েছে। বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে দেশে যেখানে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৩ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান চাষ হয়েছিল, ৫ বছরের মাথায় ২০২০-২১ অর্থবছরে তার পরিধি বেড়ে ১২ লাখ ১১ হাজার ৯৯৯ হেক্টরে ঠেকেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯২ হাজার ৪৪৭ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড জাতের আমন চাষ হয়েছিল। আর ২০২০-২১ অর্থবছর তা বেড়ে দুই লাখ ৪২ হাজার ৬৬১ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে হাইব্রিড জাতের আউশ আবাদের পরিমাণ যেখানে ছিল ৩৬ হাজার ৯০৫ হেক্টর, ২০২০-২১ অর্থবছরে আবাদ বেড়ে ৫৬ হাজার ৫২০ হেক্টরে হয়েছে। উফশী বা স্থানীয় জাতের চেয়ে হাইব্রিড ধানের উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। ফলে কৃষকদের কাছে ধানের হাইব্রিড জাতগুলো ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশে আবাদি জমির পরিমাণ যেভাবে কমছে, তাতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে দ্রুতই কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড ধানের আবাদ ছড়িয়ে দেয়া জরুরি। নইলে জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে খাদ্যনিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ জমিতে ধান চাষ হয় (আউশ, আমন ও বোরো মৌসুম) তার প্রায় ৮১ শতাংশের বেশি জমিতে উৎপাদিত হয় উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের ধান। আর প্রায় ১১ শতাংশ জমিতে চাষ হচ্ছে হাইব্রিড জাতের ধান। তাছাড়া প্রায় ৭ শতাংশ জমিতে দেশী বা স্থানীয় জাতের ধান চাষ হয়।
সূত্র জানায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৮ লাখ ৭ হাজার ২৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তার মধ্যে ১২ লাখ তিন হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড, উফশীজাত ৩৬ লাখ ১৫ হাজার ৮০ হেক্টর ও ২০ হাজার হেক্টর। এ বছর ২ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টন বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তার মধ্যে হাইব্রিড থেকে ৬০ লাখ ৮৭ হাজার ৯০০ টন, উফশীজাত থেকে এক কোটি ৪৮ লাখ ২৬ হাজার টন এবং স্থানীয় জাত থেকে ৩৭ হাজার টন। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি বিভাগ বোরো মৌসুমে ২ কোটি ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টন ধান উৎপাদন করতে চায়। সেক্ষেত্রে হাইব্রিড ধান আবাদ এলাকা প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, দেশে আউশ মৌসুমে উফশী জাত ৮৮.০৬ শতাংশ, আমন ৮১.৩৭ শতাংশ এবং বোরো মৌসুমে ৭৪.৬৪ শতাংশ জমিতে ধান চাষ হয়। একইভাবে হাইব্রিড ধান চাষ হয় যথাক্রমে ৪.৩১ শতাংশ, ৪.৩৮ শতাংশ এবং ২৪.৮৭ শতাংশ জমিতে। অর্থাৎ বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধান চাষ বাড়লেও আমন ও আউশে পিছিয়ে আছে। তবে বিগত ৫ বছরে বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধান আবাদের পরিধি অনেক বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে ৪৫ লাখ ১৭ হাজার ২৫৬ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। তার মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৩ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান চাষ হয়। ফলে পাঁচ বছরের মাথায় ২০২০-২১ অর্থবছরে হাইব্রিড ধান আবাদের পরিধি বেড়ে ১২ লাখ ১১ হাজার ৯৯৯ হেক্টরে গিয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ওই সময়ে বোরো আবাদের পরিধি বেড়েছে প্রায় ৭.৮৭ শতাংশ। তবে হাইব্রিড চাষের এলাকা বেড়েছে ৮৩ শতাংশেরও বেশি। ওই ৫ বছরে উফশী জাতের ধান প্রায় ৫ শতাংশ এবং স্থানীয় জাতের ধান চাষ ৩২ শতাংশেরও বেশি কমেছে। বিগত ৫ বছরে বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি হাইব্রিড ধান চাষ হওয়া জেলাগুলো হলো ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, সুনামগঞ্জ, শেরপুর, গোপালগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, হবিগঞ্জ, বাগেরহাট, জামালপুর, রংপুর, গাইবান্ধা ও নীলফামারী। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ওই ১২ জেলায় যেখানে বোরো মৌসুমে ৩ লাখ ৫২ হাজার ৬৯ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান আবাদ হয়েছে, ২০২১ সালে তা বেড়ে ৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৩৯ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ওই ১২ জেলায় হাইব্রিড ধান আবাদ এলাকা ৫১ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
এদিকে ২০২০-২১ সালের মাঠ তথ্যানুযায়ী অধিক আবাদি ২৩ জেলা হলো কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কুমিল¬া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, বরিশাল ও গোপালগঞ্জ। সারাদেশ মিলে যেখানে ১২ লাখ ১১ হাজার ৯৯৯ হেক্টর জমিতে বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধান চাষ হয়, সেখান শুধু ওই ২৩ জেলাতেই আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ১৫ হাজার ৭৭০ হেক্টর; যা এলাকা হাইব্রিড আবাদের ৭৫.৫৬ ভাগ। তাছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সারাদেশে ৫৩ লাখ ৫৩ হাজার ৮০৬ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছিল। তখন হাইব্রিড আবাদের পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৪৪৭ হেক্টর। কিন্তু ৫ বছরের মাথায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৬৬১ হেক্টর। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ১ লাখ ৬২ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে আমনে হাইব্রিড ধানের চাষ বেড়েছে। একইভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে উফশী জাতের ধান চাষ হয়েছিল, সেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৪৫ লাখ পাঁচ হাজার ৫২৭ হেক্টর। অর্থাৎ ৬ হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে উফশী জাতের আমন চাষ বেড়েছে। তবে কমেছে স্থানীয় জাতের আবাদ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে দেশে ১০ লাখ ২৩ হাজার ৯৪ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের ধান চাষ হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা প্রায় ২৩ শতাংশ কমে হয়েছে ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৬২৫ হেক্টর। ডিএইর মাঠ তথ্যানুযায়ী ২০২০-২১ সালের সারাদেশে ২ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে হাইব্রিড আমন জাত আবাদ হয়েছে। তার মধ্যে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নাটোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, যশোর, মাগুরা, কুষ্টিয়া, নড়াইল ওই ২২টি জেলাতেই আবাদ হয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার হেক্টর; যা ওই মৌসুমে হাইব্রিড আবাদের ৮৭.৬ শতাংশ। আর গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১৩ লাখ ১২ হাজার ৩৮৬ হেক্টর জমিতে আউশ ধানের আবাদ হয়েছে। তার মধ্যে ৫৬ হাজার ৫২০ হেক্টরে হাইব্রিড আবাদ হয়েছে, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৩৬ হাজার ৯০৫ হেক্টর। ওই বছর আউশ আবাদ ছিল ৯ লাখ ৪১ হাজার ৬৮১ হেক্টর। ৫ বছরে (২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত) তা ৩৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে হাইব্রিড আবাদ এলাকা ৫৩ দশমিক ১৫ শতাংশ, উফশী জাত ৫৬ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়েছে। তবে একই সময়ে স্থানীয় জাতের ধান আবাদ ৪০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। সরকার ওই আউশ মৌসুমে হাইব্রিড ধানের চাষ বাড়াতে গুরুত্ব দিচ্ছে।
অন্যদিকে হাইব্রিড ধানের আবাদ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (সম্প্রসারণ ও কো-অর্ডিনেশন) হাবিবুর রহমান চৌধুরী এক উপস্থাপনায় বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রম হ্রাসমান কৃষি জমির প্রেক্ষাপটে ধান উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান ধারা বজায় রাখার জন্য উচ্চ উৎপাদনশীল হাইব্রিড জাতের বিকল্প নেই। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক চাষের জন্য ছাড়প্রাপ্ত হাইব্রিড জাতের ৭৪ শতাংশের উৎস চীন, ১৯ শতাংশ ভারত, ৬ শতাংশ বাংলাদেশ। উফশী জাতের তুলনায় হাইব্রিড ধান চাষে ৩০-৪০ শতাংশ ফলন বেশি হয়। খাদ্য অধিদফতর মোটা ধান কেনায় হাইব্রিডের চাহিদা বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো: বেনজীর আলম জানান, দেশে কৃষি জমি কমছে। কিন্তু প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ লোকসংখ্যা যোগ হচ্ছে। নতুন ফসল আসছে, যেগুলো উচ্চ মূল্যের। সুতরাং খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। হাইব্রিডে ফলন বেশি। এদেশের বিজ্ঞানীরা খুবই কম হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করেছেন। সেজন্য আমদানি বেশি। সুতরাং যে বীজ দরকার ওই ক্যাপাসিটি এখনো দেশে গড়ে ওঠেনি। হাইব্রিড ধান থেকে সংগ্রহ করা যায় না। পুরোটাই আলাদাভাবে উৎপাদন করতে হয়। তাই হাইব্রিডের পাশাপাশি উচ্চফলনশীল কিছু ইনব্রিড নতুন জাত এসেছে, সেগুলো সম্প্রসারণেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
কমতে শুরু করেছে কুড়িগ্রামের নদীর পানি, ভাঙন আতঙ্কে মানুষ
দিনাজপুরে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় নিহত ২