নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশ থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে চিংড়ি রপ্তানি। অথচ সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি দেশের একটি অন্যতম রপ্তানি পণ্য। দেশের অর্থনীতিতে চিংড়ি শিল্পের বড় অবদান রয়েছে। আর খুলনা অঞ্চল থেকেই মোট উৎপাদিত চিংড়ির সিংহভাগ আসে। তবে একসময়ের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্যটি কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকায় এখন সপ্তম তালিকায় নেমে গেছে। ক্রমবর্ধমান রপ্তানি কমার কারণ হিসেবে বিদেশের বাজারে চিংড়ির দাম কমা, নানা অপদ্রব্য মেশানোয় সুনাম নষ্ট হওয়া এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ খাত থেকে মুনাফা কমাকে দায়ি করা হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ে চিংড়ি চাষে অনীহা বাড়ছে চাষীদের। তাছাড়া নোনা পানির যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ কমায় চিংড়ি ঘেরের সংখ্যাও আগের চেয়ে কমেছে। পাশাপাশি ভেনামি চিংড়ি (প্যাসিফিক হোয়াইট-লেগড শ্রিম্প অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা চিংড়ি) ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে জনপ্রিয় হওয়ায় দেশের বাগদা ও গলদা চিংড়ি মার খাচ্ছে। চিংড়ি চাষী ও বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জলবায়ুর প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ-বালাইসহ নানাবিধ কারণে গত কয়েক বছর ধরেই সম্ভাবনাময় এ শিল্প চরম সংকটে রয়েছে। চিংড়ির পোনা, খাদ্য, শ্রমিকের মজুরি, পরিবহনসহ সব খরচ বাড়লেও সেভাবে বাড়েনি চিংড়ির দাম। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মূলধনই টিকতে পারছে না প্রান্তিক চাষীরা। তারা ঋণ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। এসব নানা সংকটে অনেকেই চিংড়ি চাষে জীবিকা নির্বাহ থেকে সরে আসছে। চাষীদের অভিযোগ, চিংড়ি শিল্প পুরোটাই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দখলে। কারসাজি করে তারা কম দামে চিংড়ি বিক্রি করতে বাধ্য করে। মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রান্তিক চাষীরা। আবার একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ওজন বাড়াতে চিংড়ির ভেতরে বিভিন্ন জেলিজাতীয় অপদ্রব্য ঢুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত কারখানায় পাঠাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ অপচেষ্টা বেড়েছে ব্যাপক হারে। এরইমধ্যে বিভিন্ন অভিযানে তা ধরাও পড়ছে। এ ধরনের প্রবণতাকে রপ্তানি খাতের জন্য অশনিসংকেত বলছেন রপ্তানিকারকরা।
তবে চাষীরা বলছেন, তাদের পর্যায়ে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা হয় না। কাজটি সাধারণত করা হয় ডিপোগুলোয়। ওই ব্যবসায়ীরা চাষীদের কাছ থেকে চিংড়ি কিনে শ্রমিকদের দিয়ে জেলি পুশ করে প্রক্রিয়াজাত কারখানায় পাঠায়। সূত্র জানায়, আশির দশক থেকে দেশের খুলনা এলাকায় লবণাক্ত পানিতে বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। ওই অঞ্চলে দেশের মোট উৎপাদিত চিংড়ির সিংহভাগই উৎপাদিত হয়। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের কয়েক হাজার মানুষের আয়ের একমাত্র উৎস চিংড়ি চাষ। এ অঞ্চলে উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ ইউরোপসহ বিশ্বের ৩২টি দেশে রপ্তানি হয়। তবে বিগত কয়েক বছর খুলনাঞ্চল থেকে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিতে বেশ ভাঁটা পড়েছে। মূলত সাত বছর ধরে চিংড়ি রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশ থেকে ৪০ হাজার ৭০২ টন হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করা হয়।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৩৯ হাজার ৭০৬ টন। ৩৬ হাজার ১৬৮ টন রপ্তানি হয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরো কমে ৩৩ হাজার ৩০৬ টনে নেমে আসে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদেশ পাঠানো হয় ৩০ হাজার ৩৬ টন। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৫৭১ টন রপ্তানি হয়। আর এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে চিংড়ি রপ্তানি তলানিতে এসে ঠেশার আশঙ্কা রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল খাতে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫০ কোটি ডলার। তবে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) চিংড়ি রপ্তানিতে আয় কমেছে ৩১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। সর্বশেষ তথ্য এখনো সমন্বয় করা যায়নি। তবে খুলনা অঞ্চল থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় হিমায়িত চিংড়ির রপ্তানি কমেছে চার হাজার টন।
ইউরোপীয় দেশগুলোতে চাহিদা কম থাকায় মূলত এর রপ্তানি কমেছে। আগে খুলনাঞ্চলে ব্যাপকভাবে চিংড়ি চাষ হতো। তবে এখন আগের মতো উন্মুক্ত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ হয় না। নোনা পানি ঢুকতেও বাধা দেয়া হয়। এতে দেশের রপ্তানির এ খাত মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থায় পৌঁছেছে। ফলে সময় এসেছে চিংড়ি চাষের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড, মৎস্য বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসনসহ সব সেক্টরের সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার। অল্প জায়গায় বেশি চিংড়ি উৎপাদনের জন্য চাষীদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশের বিরুদ্ধেও অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এদিকে সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষিণ উপকূলের চাষীদের সুসংগঠিত করে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় মাছ চাষীদের সুসংগঠিত করে ৩০০ ক্লাস্টারকে প্রকল্পভুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিটি ক্লাস্টারে রয়েছে ২৫টি ঘের, যেগুলোর আয়তন ৩৩ থেকে ১৫০ শতক। উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এটি একটি কার্যকর উপায় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ক্লাস্টারভুক্ত চাষীরা একরপ্রতি (একশ শতক) অফেরতযোগ্য ১ লাখ ৮১ হাজার টাকা আর্থিক অনুদানও পাবেন। অন্যদিকে সার্বিক বিষয়ে বিএফএফইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল বাকী জানান, বিশ্ববাজারে চিংড়ির ক্রেতারা এখন কম মূল্যের কারণে ভেনামি জাতের চিংড়ির দিকে ঝুঁকেছে। আমাদেরও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ জাতের চিংড়ি চাষের অনুমতি দিয়েছে সরকার। এখন বাজার ধরে রাখতে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ বাড়াতে হবে। তবে অনুমতি মিললেও ভেনামি চিংড়ি চাষে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ