November 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, November 3rd, 2022, 9:32 pm

ধীরগতির কবলে রেলের ৩ ডজন উন্নয়ন প্রকল্প

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

ধীরগতির কবলে রেলের ৩ ডজন প্রকল্প। সারাদেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করার লক্ষ্যে ওসব প্রকল্প নেয়া হলেও গত ১১ বছরে একটি প্রকল্পের কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। বর্তমানে রেলওয়েতে ৩৬টি প্রকল্পের কাজ চলছে। তার মধ্যে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ১৩টি, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ৩টি, ভারতীয় রাষ্ট্রীয় ঋণে (এলওসি) ৬টি, চীনের অর্থায়নে ৩টি ও টেন্ডারার্স ফাইন্যান্সিং ২টি। তাছাড়া জাইকা, ডিআরজিও, ইডিসিএফ ও ভারতীয় সরকারের অনুদানে একটি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যমান রেললাইন সংস্কার না হওয়ার কারণে যাত্রীবাহী ট্রেনের গতি বাড়েনি। বরং পাথরবিহীন নড়বড়ে রেললাইনের কারণে প্রতিনিয়ত ট্রেনে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া ইঞ্জিন ও কোচ সংকটের কারণেও রেলওয়ে চাহিদা অনুসারে ট্রেন পরিচালনা করতে পারে না। বর্তমানে রেলওয়ের যাত্রীবাহী ট্রেনের সংখ্যা ৩৬৮টি হলেও বাস্তবে চলছে ২৭৬টি। কোচ ও ইঞ্জিন সংকটের কারণে ৯২ ট্রেন চলাচল করতে পারছে না। তাছাড়া পণ্যবাহী ট্রেনের জন্যও ইঞ্জিনের চাহিদা রয়েছে। আর রেলওয়ের চাহিদার আলোকে ট্রেন পরিচালনার জন্য ৩-৪ হাজার কোচ দরকার হলেও রয়েছে ১ হাজার ৬৮৫টি কোচ। পণ্য ও যাত্রীবাহী ট্রেনের জন্য প্রায় ৬শ’ ইঞ্জিন দরকার কিন্তু আছে মাত্র ২৮৫টি। তার মধ্যে আবার অর্ধেকের বেশি ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। কোচ, ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশের সংকট দূর করতে রেলওয়ে ৬টি প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু গত ১১ বছরে ইঞ্জিন ও কোচ সংগ্রহের প্রকল্পের বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। আর কঠিন শর্তের কারণে চুক্তি বাতিল হচ্ছে ঠিকাদার অর্থায়নের দুটি প্রকল্প। পাশাপাশি ২১টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেক্ট্রিক লোকোমোটিভ নবরূপায়ন প্রকল্পের ৩ বছরেও কোনো অগ্রগতি নেই। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। ২০১৯ সালের নিজস্ব অর্থায়নে ২৪২ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি নেয়া হয়।
সূত্র জানায়, রেলওয়ে অপারেশন যন্ত্রাংশ রোলিং স্টক সংগ্রহের জন্য ২০১৭ সালে এডিবির অর্থায়নে একটি প্রকল্প নেয়া হয়। ওই প্রকল্পের ৩ হাজার ৬০২ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। কিন্তু গত ৫ বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২৮ শতাংশ। আগামী ২০২৪ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। ২০১৭ সালে ২০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ এবং ১৫০ মিটারগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহের প্রকল্পটি নেয়া হয়। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৫১ শতাংশ। তার মধ্যে ২০টি লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) উত্তর কোরিয়া থেকে সংগ্রহ করা হলেও ১৫০টি যাত্রীবাহী কোচ এখনও এসে পৌঁছায়নি। গত জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও তা আরো দুই বছর বৃদ্ধি করে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ডের (ইডিসিএফ) অর্থায়নে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭৯৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। আর ২০১১ সালে নেয়া হয় রেলওয়ের জন্য ৭০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেক্ট্র্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ প্রকল্প। ডিপিপি একদফা সংশোধন করে প্রকল্পটির মেয়া ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। কিন্তু গত ১১ বছরে প্রকল্পের কোনো কাজই হয়নি। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন মাত্র শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রকল্পটির টেন্ডারার্স ফাইন্যান্সিং বাস্তবায়নের জন্য রেলওয়ে কোরিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু কিছু কঠিন শর্তের কারণে গত আগস্টে চুক্তিটি বাতিল করেছে রেলওয়ে। তাছাড়া ২০১৬ সালে ২০০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহের প্রকল্প নেয়া হয় এবং ২০২৪ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ৬ বছরে প্রকল্পের কোনো কাজই হয়নি। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের সঙ্গে একটি ঋণচুক্তি হয়েছিল। কিন্তু শর্তের কারণে তা বাতিল করা হয়।
সূত্র আরো জানায়, রেলওয়ের মেগা প্রকল্প দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ। ২০১০ সালে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজ ৩ বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ১২ বছরেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। বরং চার দফা মেয়াদ বৃদ্ধি করে সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ব্যয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পে ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া-শাহবাজপুর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্নিমাণ প্রকল্পটি সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রয়েছে। গত ১১ বছরে ওই প্রকল্পে কোনো অগ্রগতি নেই বললেই চলে। ২০১১ সালে নেয়া প্রকল্পটির গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আর তিন দফা মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। তাছাড়া ব্যয় ১১৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ট্রান্স-এশিয়ান রেল রুটে অন্তর্ভুক্তির জন্য রেলপথটি পুনর্নিমাণের প্রকল্প নেয়া হয়। তাছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৫০৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০২০ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৫ শতাংশ।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, সারাদেশে রেলপথ উন্নয়নে মোট ১ লাখ ৪১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণদাতা সংস্থার অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। তার মধ্যে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ৯১ হাজার ১৯১ কোটি ২২ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। আর সরকারি ফান্ড থেকে বাকি ৫০ হাজার ৫০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয় হবে। কিন্তু প্রকল্পের ধীরগতির কারণে ঋণের সুদের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাছাড়া প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বর্তমান সরকারের সারাদেশের রেলপথ উন্নয়নে নজর দেয়া ভালো লক্ষণ। কারণ গত ৪০ বছরে রেলওয়েতে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। বিদ্যমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন না হলে রেলের সেবা দেয়া কঠিন হবে। সারা পৃথিবীতে রেল একটি সাশ্রয়ী পরিবহন মাধ্যম। রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে সড়কের ওপর চাপ কমবে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে ভোক্তা, উৎপাদক, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ও প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে ঋণ পরিসেবার দায়ভার বাড়বে, ঋণের দায়ভার বাড়বে ও ভোক্তারা সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে।
অন্যদিকে রেলওয়ের প্রকল্পগুলো বিষয়ে এ বিষয়ে রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের মতে, রেলওয়ে কোচ ও ইঞ্জিন সংকট সমাধানে প্রকল্প নেয়া আছে। পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে অর্থায়ন সংকটের কারণে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লাগছে। ওই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে আশা করি ইঞ্জিন ও কোচের সংকট কিছুটা সমাধান হবে। তাছাড়া কঠিন কিছু শর্তের কারণেও রেল প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল করা হয়েছে। এখন অন্যভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, চলতি বছরের জুনে রেলওয়ের অনেক প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে দুই বছর প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেছে। মহামারীর কারণে যেখানে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল সেখানে প্রকল্পের কাজ কিভাবে হয়। তাই বাস্তবতা বিবেচনায় কিছুকিছু প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ব্যয় বাড়ানো হয়নি।