নিজস্ব প্রতিবেদক:
সরকার নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে চাচ্ছে। ওই লক্ষ্যে হাতে নেয়া হচ্ছে একগুচ্ছ প্রকল্প। ওসব প্রকল্প থেকে আগামী ২০২৪ সালের জুন নাগাদ সুফল মিলবে। তাছাড়া আরো দুই ডজনেরও বেশি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প পাইপ লাইনে আছে। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট। তার মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশের মতো নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। কেউ কেউ দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কাও করছেন। এমন পরিস্থিতিতে খরচ কমাতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে সরকার গুরুত্ব বাড়াচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারের নেয়া নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে খুলনা তেরখাদায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, চুয়াডাঙ্গায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ৪২ মেগাওয়াট বর্জ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, পাবনার ঈশ্বরদীতে ৭০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, জামালপুরে ১০০ মেগাওয়াট সোলার পার্ক, জামালপুরে ৮৫২ কিলোওয়াট রুফটপ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, সিলেটে ১০ মেগাওয়াট সোলার পার্ক, পঞ্চগড়ে ৫০ মেগাওয়াট সৌর পার্ক, চাঁদপুরে ৭ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, নীলফামারীর ডিমলায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে ২০ মেগাওয়াট সৌর পার্ক, ধামরাইয়ে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জে ৬ মেগাওয়াট বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। ওসব প্রকল্পের কাজ চলমান। আগামী ২০২৪ সালের জুন নাগাদ ওসব প্রকল্প থেকে সুফল মিলবে বলে আশা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং একটি টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থায় পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী দলগুলো নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়ে আসছে। প্রাকৃতিক উৎস সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি, শহুরে বর্জ্য ইত্যাদি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। তাতে পরিবেশের সুরক্ষার বিষয়টিও গুরুত্ব পায়।
সূত্র জানায়, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৬৬ দশমিক ৬৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে শীর্ষে আছে পিভি সোলার, এরপর ২৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ, বায়ু থেকে ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট, জৈব-গ্যাস থেকে ০ দশমিক ৬৩ মেগাওয়াট এবং বায়োগ্যাস থেকে ০ দশমিক ৪ মেগাওয়াট। তবে উৎপাদন ক্ষমতা ৭শ মেগাওয়াট থাকলেও জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে মাত্র ২২৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যা মোট উৎপাদনের মাত্র এক শতাংশ। তবে এ খাতের উন্নয়নে নানা ধরনের প্রকল্প চলমান। আগামী ২০২৩ সালেই নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হবে। আগামী জুনে শেষ হচ্ছে চট্টগ্রামের বারইয়ারহাটে ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, মোংলার ৫৫ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র, পাবনায় ৬৪ মেগাওয়াট সৌর পার্ক, নেত্রকোনায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকে›্র্র, কক্সবাজারের ইনানীতে ৫০ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র, চাঁদপুরে ৫০ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শেষ হবে। ওসব প্রকল্পের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৩১৯ মেগাওয়াট। তবে সরকারের লক্ষ্য ২০২৩ সালের জুনে সেগুলো থেকে কমপক্ষে আরো ২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে আগ্রহী।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে দেশে ২১ হাজার ২৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। তার মধ্যে ১০ হাজার ৮৭৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে করা হয়। যা মোট উৎপাদনের ৫১ শতাংশ। তার পরে ৬৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হয় ফার্নেস অয়েল। উৎপাদন ৫ হাজার ৯২৫ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদনের ২৮ শতাংশ। তাছাড়া ডিজেল পুড়িয়ে মোট উৎপাদনের ৬ শতাংশ, কয়লা পুড়িয়ে ৮ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আর নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে মোট উৎপাদনের এক শতাংশ বিদ্যুৎ। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে তা ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। বর্তমানে ৯টি সৌরশক্তিচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণকাজ চলছে, যাদের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ৪৫০ মেগাওয়াট। তাছাড়া একটি বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পেরও কাজও চলমান। যেখান থেকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। তাছাড়াও ১২টি সৌরশক্তিচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি করা হচ্ছে। সেগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫শ মেগাওয়াট। পাশাপাশি কয়েকটি বায়ু ও বায়োমাস বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কাজও চলছে। যাদের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ১৩০ মেগাওয়াট। বিগত ২০২১ সালে শুরু হওয়া জামালপুরের মাদারগঞ্জে ১শ মেগাওয়াট সোলার পার্ক প্রকল্প থেকে ২০২৪ সালে ১শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে। আর ফেনী নদীর মোহনায় সোনাগাজীর বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকেও ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে।
এদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষিজমিতে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের নিষেধাজ্ঞা আছে। আর বৈশ্বিকভাবে যদি বিদ্যুৎ তৈরির উপকরণের দাম বাড়ে তবে বিদ্যুতের দামও দ্বিগুণ হবে। সেক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে দাম বাড়লে পুরোপুরি নবায়নযোগ্য উৎসের দিকেই যেতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ পেতে সরকার জামালপুরে ১শ মেগাওয়াট কেন্দ্র নির্মাণ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এমন একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশে সৌরশক্তির বড় অবদানটা বুঝতে পারবে। বিদ্যুতের ট্যারিফ বেশি হলেও পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম-সচিব (নবায়নযোগ্য জ্বালানি) নিরোদ চন্দ্র মন্ডল জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে ২২৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। আগামী বছরের জুনে আরো ২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। এটা অনেক বড় অর্জন। পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করেই এই বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান জানান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সরকার অনেক আশাবাদী। বর্তমানে এর জেনারেশন ক্যাপাসিটি ৭শ মেগাওয়াটেরও বেশি। তাছাড়া জামালপুরে যমুনা নদীর পাড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় ১শ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ফেনী নদীর মোহনায় সোনাগাজীর বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকেও ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে। প্রকল্পগুলো চালু হলে বিদ্যুৎখাত আরো এগিয়ে যাবে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন বড় একটা ইস্যু। সেজন্যই মূলত নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। ওই লক্ষ্যে একাধিক প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম