নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রচ- শীত, কুয়াশা, বীজতলা নষ্ট হওয়াসহ নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেই দেশজুড়ে বোরো আবাদের ধুম লেগেছে। এবার বোরো আবাদে কৃষকরাও বেশি আগ্রহী। ফলে দেশব্যাপী বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি বছর দেশে ৪৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তা থেকে বোরো চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই কোটি ৯ লাখ মেট্রিক টন। বোরো আবাদের লক্ষ্য পূরণে সরকারও এবার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। সেজন্য মোট ১৩৮ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এতা মধ্যে প্রণোদনা বাবদ ব্যয় হচ্ছে ১১৭ কোটি টাকারও বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি মৌসুমে সারাদেশে ৪৮ লাখ ৭২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তার মধ্যে উফশী অর্থাৎ উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত ৩৬ লাখ ১৫ হাজার ৮০০ হেক্টর, হাইব্রিড ধান ১২ লাখ ৩৬ হাজার ৭০০ হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের ধান ২০ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে চাষ করা হবে। আর ওই জমিতে আবাদ করে বোরো চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার ৩০২ মেট্রিক টন। তার মধ্যে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাল এক কোটি ৪৮ লাখ ২৬ হাজার ১০০ টন, হাইব্রিড ধান থেকে চাল ৬০ লাখ ৮৭ হাজার ৯০১ টন এবং স্থানীয় জাতের চাল ৩৭ হাজার ৩০১ টন। গত ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ২৬ লাখ ২ হাজার ১৮৪ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। তবে বোরো আবাদের অগ্রগতি এখনো গত বছরের চেয়ে পিছিয়ে আছে। গত বছর ওই সময়ে ২৯ লাখ ৬৩ হাজার ১৩৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ সম্পন্ন হয়েছিল। মূলত প্রচ- শীত এবং কুয়াশায় বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অনেক কৃষককে নতুন করে বীজতলা তৈরি করতে হয়েছে। আবার অনেককে বীজ চারা কিনে রোপণ করতে হয়েছে।
সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে বোরো ধানের বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। এ বছর ২ লাখ ৩১ হাজার ৬০১ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তার মধ্যে উচ্চ ফলনশীল ধানের বীজতলা ১ লাখ ৮০ হাজার ৭৯৬ হেক্টর, হাইব্রিড ধানের বীজতলা ৪৯ হাজার ৪৬৮ হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের ধানের বীজতলা ১ হাজার ৩৩৭ হেক্টর। কিন্তু ইতিমধ্যে ওই বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। গত ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ২ লাখ ৭২ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি। গত বছর ওই সময়ে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৪৬৩ হেক্টর জমিতে বোরোর বীজতলা তৈরি হয়েছিল।
সূত্র আরো জানায়, কৃষকরা এখন কুয়াশা ঢাকা শীত উপেক্ষা করে বোরো ধানের চারা রোপণের ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। বিস্তীর্ণ মাঠ জুরে কেবলই চলছে বোরো আবাদের ধুম। ভোরের আলো ফুটতেই কোমর বেঁধে ফসলের মাঠে নেমে পড়ছে কৃষকরা। বীজতলায় ধানের চারা পরিচর্যার পাশাপাশি জমি চাষাবাদের কাজও পুরোদমে চলছে। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে ধানের কচি চারার সবুজ গালিচা, কোথাও গভীর নলকূপ থেকে চলছে পানি সেচ, ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার দিয়ে চলছে জমি চাষের কাজ। আবার কৃষকরা নদী বা খাল থেকে নালা পদ্ধতিতেও পানি সংগ্রহ করছে। বোরো ধান রোপণের জন্য বীজতলা থেকে তোলা হচ্ছে ধানের চারা। কৃষকের ব্যস্ততায় শীত তাদেরকে স্পর্শ করছে না। শরীরে রয়েছে হালকা পোশাক, মাথায় গরম কাপড়। সব মিলিয়ে ফুরফুরে মেজাজে বোরো আবাদে ব্যস্ত কৃষক। আর বৃষ্টিতে যে সকল কৃষকের আলু বীজতলা নষ্ট হয়েছে তারা তাদের জমিতে হাইব্রিড বোরো ধান আবাদ করছে, যাতে বেশি ধান উৎপাদন করে আলুর ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়। তাছাড়া গত বছরের তুলনায় চলিত বছরে ধানের দাম বেশি হওয়ায় বেশিভাগ কৃষকই বোরো চাষে ঝুঁকে পড়েছে। অনেক কৃষক ভুট্টা, সরিষা চাষ না করে বোরো চাষ করছে। ফলে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বোরো ধান আবাদ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে এ বছর সরকার ধানের ফলন আরো বৃদ্ধির জন্য অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। কৃষকের মাঝে হাইব্রিড ও উফশী জাতের ধান বীজ প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। ২ লাখ ৪০০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান আবাদের জন্য ১৫ লাখ কৃষককে বিনামূল্যে হাইব্রিড ধান বীজ প্রণোদনা হিসাবে দেয়া হয়েছে। তাতে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ৬৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর ৬ লাখ কৃষককে বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে উচ্চ ফলনশীল ধানের বীজ। ওই ধানবীজ দিয়ে ৬ লাখ কৃষক ৮০ হাজার ১৬২ হেক্টর জমি চাষ করতে পারবে। সেজন্য সরকারের ব্যয় হচ্ছে ৩৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তাছাড়াও এবার বোরো ধানের পাশাপাশি দেশের ৬১ জেলায় ১০০টি প্লক প্রদর্শনী স্থাপনের জন্য প্রায় ১৫ হাজার কৃষককে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। তাতে সরকারের ব্যয় হচ্ছে আরো প্রায় ১৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। একই ১০০টি প্রদর্শনী খামার মিলিয়ে প্রায় ২ হাজার ২৪ হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল ধান আবাদ করা হবে। ওই প্রণোদনার পাশাপাশি সরকার দেশের ৬৪ জেলায় উন্নতমানের বোরো বীজ বিতরণের জন্য বিএডিসিকে ২০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা দিয়েছে। সব মিলিয়ে সরকার এ বছর বোরো আবাদ বৃদ্ধির জন্য মোট ১৩৮ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছে। তার মধ্যে প্রণোদনা বাবদ দিয়েছে ১১৭ কোটি টাকারও বেশি।
অন্যদিকে কৃষিবিদদের মতে, বর্তমানে বোরো আবাদের জন্য আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। বিশেষ করে মাঘের শেষের বৃষ্টি কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। ওই অনুকূল আবহাওয়া থাকলে চলতি মৌসুমেও বোর ধানের বাম্পার ফলন হবে। কারণ শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় মাটির আর্দ্রতা কমে গিয়েছিল। তাতে পেঁয়াজ বীজ, হালি পেঁয়াজ, ধান, গম, মসুর, কালোজিরা, ধনিয়াসহ বিভিন্ন ফসলের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। বৃষ্টির অভাবে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় চাষিরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মাঘ মাসের শেষে এসে হঠাৎ বৃষ্টি কৃষকের কাছে স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে। ওই বৃষ্টিতে ফিরে এসেছে ক্ষেতের আর্দ্রতা। ফসলও ফিরে পেয়েছে নতুন জীবন। বোরো চাষির সেচের কাজটি প্রকৃতি এবার নিজেই করে দিয়েছে। ফলে চাষির আর বাড়তি টাকা খরচ করে সেচ দেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানান, গত বছর দেশে রেকর্ড বোরো উৎপাদিত হয়েছে। এবছরও বোরো উৎপাদনের ওই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশে দ্রুত চালের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওই লক্ষ্যে অতি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাতগুলোর আবাদ বাড়ানোর জন্য সেগুলোকে মাঠে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নতুন উদ্ভাবিত অতি উচ্চ ফলনশীল ব্রি ৮৯ ও ব্রি ৯২ বোরো জাতের ধানের উৎপাদন প্রতি শতাংশে প্রায় ১ মণ। ওই জাত দুটোকে দ্রুত মাঠে নিতে প্রণোদনা হিসাবে এবার কৃষকদের বিনামূল্যে ব্রি ধান ৮৯ ও ৯২ বীজ দেয়া হয়েছে। যে সকল কৃষক ওই জাত দুটো চাষ করছে, তাদের কাছ থেকে উৎপাদিত ধানের সবটুকু বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে বীজ হিসেবে কিনে নেয়া হবে। যাতে আগামী বছর দেশে বীজ সঙ্কট না হয়। চাষির কাছে জনপ্রিয় করতে আগামী বছরও ওই জাতগুলো কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ দেয়া হবে। তাছাড়া উৎপাদন বাড়াতে গত বছরের মতো এবারও হাইব্রিড জাতের ধান বীজ কৃষকদের বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে। ওই বীজ দিয়ে ১৫ লাখ কৃষক দুই লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে হাইব্রিড ধান চাষ করতে পারবে। ফলে আশা করা যায়, দেশীয় উচ্চ ফলনশীল ধানের পাশাপাশি হাইবিৃড ধানের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম