আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে বঙ্গোপসাগরে অফশোর হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের পরিকল্পনা স্থগিত করেছে সরকার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোবাংলার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ইউএনবিকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে এই মুহূর্তে কোনো দরপত্র আহ্বানের পরিকল্পনা না করতে আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়াও এক্সনমোবিলস ইন্টারেস্ট অব এক্সপ্রেশন (ইওআই) নিয়ে অগ্রসর না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমাদের দুটি বিষয়েই বিলম্ব করতে বলা হয়েছে।’
এর আগে ২৬ জুলাই অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের জন্য ‘বাংলাদেশ অফশোর মডেল প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) ২০২৩’- খসড়া অনুমোদন করে।
ডিসেম্বরের মধ্যে বিডিং রাউন্ডকে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনার অধীনে খসড়া মডেল পিএসসি ২০২৩-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
অনুমোদনের পর ৯ আগস্ট তৎকালীন জ্বালানি সচিব ড. মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার বলেন, সরকার এক মাসের মধ্যে অফশোর হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের পরিকল্পনা করেছে।
সম্প্রতি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এলএনজি আমদানির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সেলরেট এনার্জির সঙ্গে একটি চুক্তি সই অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচনের পরে নতুন সরকার গঠিত হলে সরকার হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বান করবে।
অন্যদিকে, সরকার এলএনজি আমদানির জন্য বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সই করেছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ের সমালোচনা করেছে। তাদের মতে এই চুক্তি দেশকে আরও বেশি আমদানি করা জ্বালানির উপর নির্ভরশীল করে তুলবে।
সরকারি সূত্রের তথ্যমতে, নতুন মডেল পিএসসি বর্তমান বছরের মধ্যে অফশোর গভীর ও অগভীর পানির গ্যাস ব্লকের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। যাতে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক তেল সংস্থাগুলোর কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে এবং বঙ্গোপসাগরে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যায়।
এই উদ্যোগের আওতায় নমনীয়তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্ট ক্রুডের দামের সঙ্গে গ্যাসের দাম ট্যাগ করা হয়েছিল।
পেট্রোবাংলার এই কর্মকর্তা ইউএনবিকে বলেন, ‘পরিকল্পনার আওতায় আমরা ব্রেন্ট ক্রুডের ১০ শতাংশ গ্যাসের দাম দিতে যাচ্ছি।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, যদি ব্রেন্ট ক্রুড প্রতি ব্যারেল ৭৫ মার্কিন ডলারে লেনদেন করা হয়, তাহলে প্রতি হাজার ঘনফুট (এমসিএফ) গ্যাসের দাম হবে ৭ দশমিক ৫ ডলার।
মডেল পিএসসি ২০২৩-এর নতুন বিধান উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্যাসের দাম সবসময় আন্তর্জাতিক তেলের দামের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকবে।
মডেল পিএসসি অনুমোদনের পাশাপাশি, সরকার এক্সনমোবিলের সঙ্গেও আলোচনা করছিল; তারা ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে।
একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘অফারটি ছিল একটি ইওআই; যেখানে এক্সনমোবিল ২৬টি অফশোর ব্লকের পরিবর্তে, একটি একক ব্লক বিবেচনা করে সমগ্র সামুদ্রিক এলাকার বিষয়ে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।’
তিনি আরও বলেন, মার্কিন কোম্পানি অবশ্য প্রস্তাবে তেল বা গ্যাসের কোনো দাম উল্লেখ করেনি।
সরকারি সূত্র জানায়, দেশে মোট ৪৮টি ব্লক রয়েছে, যার মধ্যে ২৬টি সমুদ্রতীরে অবস্থিত। ২৬টি অফশোর ব্লকের মধ্যে ১১টি অগভীর সমুদ্রের (এসএস) পানিতে অবস্থিত এবং ১৫টি গভীর সমুদ্রের (ডিএস) পানি এলাকায় অবস্থিত।
অফশোর ব্লকগুলোর মধ্যে ২৪টি আইওসির জন্য খোলা রয়েছে, এসএস-০৪ ও এসএস-০৯ এই দুটি ব্লক ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড এবং অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগের সঙ্গে চুক্তির অধীনে রয়েছে। সেখানে সম্প্রতি ড্রিলিং কাজ শুরু হয়েছে।
প্রায় ৯ বছর আগে সমুদ্রসীমা নিয়ে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের অফশোর এলাকাটি অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।
বর্তমানে দেশের ২২টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রায় ২৩০০ এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। যেখানে প্রায় ১০০০ এমএমসিএফডি ঘাটতি রেখে প্রায় ৪০০০ এমএমসিএফডি চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে প্রায় ৭০০ এমএমসিএফডি গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে।
সরকার সর্বশেষ ২০১৯ সালের মাঝামাঝি মডেল পিএসসি সংশোধন করেছিল। যার ফলে যেকোনো অংশগ্রহণকারী আইওসি’র জন্য গ্যাসের দাম অর্থাৎ, তারা যে দামে সরকারকে গ্যাস বিক্রি করবে তা অগভীর পানির ব্লকগুলোর জন্য প্রতি এমসিএফ ৫ দশমিক ৫ ডলার এবং গভীর সমুদ্রের ব্লকগুলো থেকে উত্তোলিত গ্যাসের জন্য প্রতি এমসিএফ ৭ দশমিক ২৫ ডলার করা হয়েছিল।
২০২০ সালের মার্চ মাসে অফশোর এলাকায় অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক বিডিং আমন্ত্রণ জানানোর কথা ছিল। কিন্তু সেই সময়ে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়।
পেট্রোবাংলার আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘তেল ও গ্যাসের দামের সাম্প্রতিক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নীতিনির্ধারকদের পিএসসিতে রপ্তানির বিকল্প উন্মুক্ত রাখাসহ আরও নমনীয়তা ও প্রণোদনা প্রবর্তন করে গ্যাসের দাম আরও বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়েছে।’
তিনি উল্লেখ করেছেন, সরকারকে প্রতি এমএমবিটিইউ ৩৬ মার্কিন ডলারে এলএনজি আমদানি করতে হয়েছিল। অথচ গত বছরের শুরুতে এটি ১০ মার্কিন ডলারের নিচে ছিল।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব বাজারের অস্থিরতাকে আরও গভীর করেছে, পেট্রোলিয়ামের দাম প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের উপরে উঠেছে, যা গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এখন আবার তেল ও গ্যাসের দাম নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে এবং ব্রেন্ট ক্রুড ব্যারেল প্রতি ৭৫ ডলারে লেনদেন হচ্ছে। যেখানে এলএনজির দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ১৪ ডলারের নিচে রয়েছে।
—–ইউএনবি
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি