মইনুল হোসেন:
আমাদের জনগণ মূর্খ হতে পারেন কিন্তু নিজেদের মর্যাদা ও গৌরব রক্ষায় তারা পিছপা হননি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও এ কে ফজলুল হকের মতো মর্যাদাসম্পন্ন বড় মাপের নেতারা ছিলেন আমাদের গৌরব। তারা নিঃস্বার্থভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণে সংগ্রাম করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কত অহঙ্কার করেছি। তিনিও বৈপ্লবিক রাজনীতির শিকার হলেন। এ দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছেন, দেশে থেকে জীবন দিয়েছেন।
এখন জনগণের নির্বাচন চুরির মাধ্যমে অর্জিত রাজত্বের অবসান ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকে ব্যস্ত আছেন। নির্বাচনে ভোট চুরি করতে গিয়ে নিজেরা হেয় হয়েছেন, জাতিকেও কলঙ্কিত করেছেন। গুপ্তহত্যা ও গুমের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে জনগণকে আতঙ্কে রাখতে।
জাতিসঙ্ঘ যেন বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী নিরাপত্তারক্ষীদের জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা মিশনে গ্রহণ না করে, এখন এ তাগিদ দিচ্ছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
কী ধরনের স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি যে, জনগণের দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক আন্দোলন হঠাৎ বিলীন হয়ে গেল। গুম ও গুপ্তহত্যার রাজনীতি তো আমাদের রাজনীতি ছিল না। এর নীলনকশা অবশ্যই বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছে।
যারা এখনো ভারতের ওপর নির্ভর করে আছেন, তারা ভুল করছেন। জনগণের নির্বাচন চুরির পক্ষে ভারত থাকবে না। ভারতের সাথে বন্ধুত্ব রক্ষা করার যৌক্তিকতা উভয় দেশের জন্য অনস্বীকার্য। এজন্য দাসসুলভ আচরণের প্রয়োজন হবে না। উভয় দেশের স্বার্থে একে অপরকে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক রক্ষায় আগ্রহী হবে।
সুশিক্ষিত লোকদের নিষ্ক্রিয়তায়ই সব ধরনের অন্যায়-অবিচার চালিয়ে যেতে সুবিধাবাদীদের অসুবিধা হচ্ছে না। দেশ ও জাতি বারবার সঙ্কটে পড়েছে, নির্যাতন ভোগ করতে হচ্ছে। অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলোতেও নেতাদের ভুলভ্রান্তির কারণে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে অসহায়ভাবে হাজার হাজার মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। মা-বোনদের সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে। সত্যি বলতে গেলে স্বীকার করতে হবে যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতিকালেও আমাদের বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা দীর্ঘ নয় মাসেও পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু অনুমান করতে পারলেন না। তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনোরূপ সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। তাদের অনেককে হত্যার শিকার হতে হয়েছে।
যেভাবে হোক ভারতের সাহায্যে একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটেছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা উল্লাস প্রকাশ করে দাবি করেছেন, এটিই তাদের গৌরব এবং গর্বের স্বাধীন বাংলাদেশ!
যে ধরনের গণতান্ত্রিক শাসন পেতে জনগণ দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে আসছিলেন তা স্বাধীন বাংলাদেশে অল্প সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ধ্বংস হয়। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক শাসনের অপমৃত্যু ঘটে। একদলীয় শাসন প্রবর্তন করে জনগণকে সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। দেশে গুপ্তহত্যা ও গুমের শাসন চাপিয়ে দেয়া হয়। এখন তো গণতান্ত্রিক সুশাসনের কথা বললেই তা সরকারবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এতবড় সঙ্কটের সময়ও আমাদের সুশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের পাণ্ডিত্য নিয়ে জনবিচ্ছিন্ন রইলেন। নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে তৎপর হয়ে উঠল সুবিধাবাদী শিক্ষিত শ্রেণী।
একদলীয় শাসন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন এটি তার দ্বিতীয় বিপ্লব। প্রথম বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু অসহায় জনগণ অসহায়ই থেকে গেলেন। আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন যে, বিপ্লবী রাজনীতি আমাদের জন্য নয়। এ পথে গেলে আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনা হবে। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। সুশীলসমাজ নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকলেন। জনগণের মৌলিক অধিকার বলতে কিছু থাকল না। সুবিচার পাওয়ার স্বাধীন বিচার বিভাগেরও গুরুত্ব অস্বীকার করা হলো।
এরপর শুরু হলো জনগণের নির্বাচন চুরির দৌরাত্ম্য। শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করা হলো। যাতে জনগণের ভোটে সরকার পরিবর্তন করা অসম্ভব হয়। ভোট চুরির নির্বাচনের ব্যাপারেও শিক্ষিত লোকদের প্রতিবাদী ভূমিকা দেখা গেল না।
জাতীয় জীবনে একের পর এক সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু আমাদের সুশিক্ষিত নাগরিকদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না। প্রতিবাদ করা যে সহজ ছিল তা বলছি না। কিন্তু জাতির বিবেক হিসেবে কিছুটা সাহস তো তাদের দেখাতে হবে।
ভাবতে অবাক লাগে জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে আমরা কী পরিচয় নিয়ে বেঁচে আছি। নিজেদের মৌলিক অধিকার রক্ষার সচেতনতাও আমাদের মধ্যে নেই। নিজেদের ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনের স্বাধীনতা রক্ষা করতেও আমরা অক্ষম। দেশ-বিদেশের বড় বড় ডিগ্রিধারীরা নিজেদের পাণ্ডিত্য নিয়ে নীরব থাকাকে সার্থক জীবন হিসেবে দেখছেন। এখন আমাদের ভোটের অধিকার রক্ষায় আমেরিকাকে প্রত্যক্ষভাবে পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে, সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসতে হচ্ছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমনকি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও আমাদের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের সাফ কথা, আসন্ন নির্বাচনে ভোট চুরির ব্যবস্থা তারা মেনে নেবে না। কারণ, ভোট ডাকাতির সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার নয়। রাষ্ট্রীয় শাসন নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী দুর্নীতিবাজদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রকামী জনগণ যে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন নন তার প্রমাণ আমরা দেখছি।
সুশিক্ষিত লোকদের সক্রিয় ভূমিকা না থাকার জন্যই একশ্রেণীর সুবিধাবাদী শিক্ষিত লোকের সহযোগিতায় সব ধরনের অন্যায়-অবিচার চালানো সম্ভব হয়েছে। পেছনে যে শক্তি-ই থাকুক না কেন; আমাদের লোকেরাই গুপ্তহত্যা ও গুমের কাজে সহযোগিতা করেছে। গণবিরোধী কাজ করে সহজে বিপুল বিত্তের অধিকারী হয়েছে। জনগণের ওপর কী নিষ্ঠুরতা চলেছে তা বিবেচনায় নেয়ার মতো রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিঃস্বার্থ জনসেবার পরিবর্তে রাজনীতি এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে লুটেরাদের ব্যবসা। বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস থেকে তো আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। আসল সময়ে সাহসী নেতাদের খুঁজে পাওয়া গেল না।
ভোট চুরির সরকার পদ্মা সেতুসহ ইট-পাথর আর লোহা-লক্কড়ের অনেক বড় বড় প্রকল্প দেখিয়ে সবাইকে নিজেদের যোগ্যতা ও সাফল্যের চমক দেখাচ্ছে। মেগা প্রজেক্টের নামে মেগা দুর্নীতির কথাও চাপা থাকছে না। সাধারণ মানুষ আর্থিক অনটনে চার দিকে অন্ধকার দেখছেন। জনগণের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে, যাতে তারা সেখানে বিলাসী জীবনযাপন করতে পারে। আমাদের গরিব জনগোষ্ঠী অধিকতর গরিব হচ্ছে।
সবকিছুর পরও আবেদন জানাব, দেশকে বিপজ্জনক রক্তপাতের দিকে না নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে সুযোগ আসছে তার সদ্ব্যবহার করুন। এটাই হবে আওয়ামী লীগের জন্য সঠিক ও দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুকূল সহনশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের সবাই যে দলটির গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের কথা ভুলে গেছেন তা আমরা মনে করি না।
জাতিকে সঙ্কট থেকে রক্ষায় শিক্ষিত লোকদের দায়িত্ব সম্পর্কে এইচজি ওয়েলস তার ‘আউটলাইনস অব হিস্টোরি’ বইতে কী বলেছেন তার কথার একটা উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি : In our race between education and catastrophe our education failed us allowing catastrophe to happen again and again. তার বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে, সুশিক্ষিত লোকদের ব্যর্থতার জন্যই বারে বারে আমাদের সঙ্কটে পড়তে হচ্ছে।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ