March 29, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, March 26th, 2023, 4:36 pm

নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না ‘সাকার ফিশ’, ভয়াবহ হুমকির মুখে দেশী মাছ

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নদী-পুকুরসহ দেশের প্রায় সব ধরনের জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়েছে অ্যাকুয়ারিয়ামের শোভাবর্ধক ও আবর্জনাভুক ‘সাকার’ মাছ। দ্রুত বংশবিস্তারের মাধ্যমে দখল করছে অন্য মাছের আবাসস্থল। উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের ডিম ও নিচের শ্যাওলা-আবর্জনা খেয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে খাদ্যশৃঙ্খলে। খাবার হিসেবে অত্যন্ত নিম্নমানের এই মাছ দ্রুত দখল নিচ্ছে জলাশয়ের। সব মিলিয়ে এটি এখন দেশি মাছের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে এবার মাছটি নিষিদ্ধ করেছে সরকার। গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে আইনগতভাবে এই মাছটি আমদানি, উৎপাদন, বিপণনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু এর আগেই মাছটি ব্যাপকভাবে জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের নদী-বিল তো বটেই, ডোবা-নালাতেও হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে সাকার মাউথ ক্যাটফিশ। জলজ বাস্তুসংস্থান ও দেশি মাছের অস্তিত্বের জন্য ভয়ানক হুমকি হয়ে উঠেছে এ মাছ। তাই এ মাছটিকে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এর বিকল্প ব্যবহার নিয়ে ভাবছেন গবেষকরা। সাকার ফিশের বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকোসটোমাস। অ্যাকুরিয়ামের শোভা বাড়াতে এবং এর কাচে জন্মানো শ্যাওলা পরিস্কার করার উদ্দেশ্যে এ মাছ আমদানি করা হয়েছিল। শ্যাওলা খেয়ে কাচকে পরিস্কারও রাখে এ মাছ। কিন্তু অ্যাকুরিয়ামের এ মাছ এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন নদ-নদী এবং জলাশয়েও। গবেষকরা বলছেন, রাক্ষুসে প্রজাতির না হলেও সাকার ফিশ প্রচুর খাবার খায়। বংশ বিস্তার করে দ্রুত। জলজ পোকামাকড় ও শ্যাওলার পাশাপাশি ছোট মাছ এবং মাছের পোনাও খেয়ে থাকে সাকার। তা ছাড়া এ মাছের পাখনা খুব ধারালো হওয়ায় এর আঘাতে সহজেই অন্য মাছের দেহে ক্ষত হয় এবং পরে পচন ধরে মারা যায়। দেশের বুড়িগঙ্গাসহ বিভিন্ন নদী ও জলাশয়ে এখন সাকার মাছের সঙ্গে দেশীয় প্রজাতির মাছের খাদ্যের জোগান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতার আশঙ্কা করছেন গবেষকরা। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য এই প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশীয় মাছ ও পুকুরে চাষের মাছের উৎপাদনেও বাধা সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট ও বাস্তুসংস্থান ধ্বংস করার মাধ্যমে জলাশয়ের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিতে পারে। তা ছাড়া দ্রুত বংশবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সাকার মাছ জলাশয়ের পাড় ধ্বংস, দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু ভক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করাসহ নানা ক্ষতি করতে পারে। মৎস্য ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাকার ফিশের ক্ষতিকর প্রভাবে ভারত, মিয়ানমারসহ আরও অনেক দেশের মৎস্য চাষিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাংলাদেশে আসা সাকার প্রজাতির মাছটি ১৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। মাছটি পানি ছাড়াও প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে। মৎস্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যেই নির্দেশনা দিয়েছে যে, এ মাছ যাতে কোনোভাবেই উন্মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে মনিটরিং করা হোক। অধিদপ্তর এ মাছটি চাষ ও উন্মুক্ত জলাশয়ে পাওয়া গেলে তা নষ্ট করার নির্দেশনাও দিয়েছে। মহাবিড়ম্বনার এই সাকার ফিশ কীভাবে জলাশয় থেকে কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। গবেষক দলের প্রধান ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, এর দেহে শতকরা ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ পর্যন্ত আমিষ রয়েছে। তাই দেশের সাধারণ মানুষ এই মাছটি খেতে পারবে কিনা বা খেলে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কিনা, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। মাছটি খাওয়ার যোগ্য হলে সঠিক প্রচার ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে এর চাহিদা তৈরি করা যেতে পারে। খাদ্য হিসেবে গৃহীত হলে এটি একদিকে যেমন আমিষের চাহিদা পূরণ করবে, অন্যদিকে এর চাহিদা তৈরি হলে সাধারণ জেলে ও মাছ চাষিরা এটি আহরণ ও বিক্রি শুরু করবে। ফলে অযাচিত এ মাছ কমে আসতে থাকবে। অধ্যাপক হাবীব জানান, মাছটি যেহেতু বুড়িগঙ্গা নদীর পানির মতো বিষাক্ত পানিতে বেঁচে থাকতে পারে, তাই এটি নিয়ে আরও বিশদ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এ বিষয়ে তারা গবেষণা করছেন। গবেষণায় ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না মেলা পর্যন্ত এ মাছ খাওয়া ঠিক হবে না। মাছটি যেন আর আমদানি না করা হয় বা দেশে এর কৃত্রিম প্রজনন যেন ঘটানো না হয়, সে বিষয়েও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অ্যাকুরিয়ামে লালনের জন্য বিদেশি মাছ আমদানির ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। মৎস্য সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০১ বা ২০০২ সালের দিকে ইউরোপের এক কূটনীতিক মেয়াদ শেষে চলে যাওয়ার আগে ঢাকার গুলশান লেকে কয়েকটি সাকার মাছ ছেড়ে দেন। এরপর সেখান থেকেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এটি। বাংলাদেশে প্রাপ্ত সাকার ফিশ ১৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। এটি পানি ছাড়াই প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে। মৎস্য আইন ২০১১ অনুযায়ী বাংলাদেশে দেশীয় প্রজাতির মাছের ক্ষতি করে এমন যে কোনো বিদেশি মাছ আমদানি ও চাষ দ-নীয় অপরাধ। জেলেরা জানান, বুড়িগঙ্গাসহ দেশের কিছু নদ-নদীতে জাল ফেললে দেশীয় মাছের চেয়ে সাকার মাছই বেশি উঠছে। এসব মাছ পেলে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। অন্যথায় এসব মাছ আবার অন্য মাছের ডিম খেয়ে ফেলে। সাকার ফিশ দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে বিধায় উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশবৃদ্ধি ও প্রজননে বিঘœ সৃষ্টি করে। দেশীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে খাদ্য ও পরিবেশ নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। এ মাছটি দ্রুত বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম বলে জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়লে জলাশয়ের পাড়ে ১ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত গর্ত তৈরি করে তা ধ্বংস করে। দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু ভক্ষণ করে মাছের বংশ বিস্তারে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। জলাশয়ের তলার শ্যাওলা ও জৈব আবর্জনা খায় বিধায় জলজ পরিবেশের সহনশীল খাদ্যশৃঙ্খলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। সাকার মাছের সঙ্গে স্বল্পায়ু, তৃণভোজী, খরাকাতর দেশীয় মাছের অসম প্রতিযোগিতা হয় বলে দেশীয় মাছের উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ নানাবিধ ক্ষতি করে। দ্রুত এ সমস্যা সমাধান না হলে সাকার মাছের সংখ্যা আরও বাড়বে।