November 14, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, October 7th, 2021, 8:49 pm

নীতিমালার ফাঁকফোকর গলে চলছে সোনার অদম্য চোরাচালান

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সোনা চোরাচালান থামছেই না। প্রায় প্রতিদিনই পাচার হয়ে আসা সোনা ধরা পড়ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে। কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, যত সোনা ধরা পড়ছে, তার কয়েক গুণ বেশি সোনা পাচার হয়ে যাচ্ছে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি উড়োজাহাজের ভেতর থেকে প্রায় ১৪ কেজি ওজনের ১২০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের একটি দল। জব্দ করা স্বর্ণের বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে ওই স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়।
সোনা পাচারের সব চেয়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য ট্রানজিট রুট এখন বাংলাদেশ। আর পাচারের নিরাপদ পথ বিমানবন্দর। প্রায় প্রতিদিনই পাচার হয়ে আসা সোনা ধরা পড়ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে। তবে বাস ও ট্রেনে সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরা, বেনাপোল, কুষ্টিয়া, যশোর, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী দিয়েও পাচার হয়ে দেশে আসছে সোনা। সোনা পাচারে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে দুই বাংলায় শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সক্রিয় এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কাতার, ওমান, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের দেশগুলোর সোনা ভারতে পাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নিরাপদ ও প্রধান ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে গোল্ড স্মাগলাররা।
শুল্ক গোয়েন্দা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নথিপত্র থেকে দেখা গেছে, গত ৮ বছরে (আগস্ট ২০১২ থেকে আগস্ট ২০২০) আড়াই টন চোরা সোনা জব্দ করা হয়েছে। এর বাজারমূল্য প্রায় ১১শ’ কোটি টাকা। পাঁচ বছরে সোনা পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৬০ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বিদেশিও রয়েছেন। এ সময় বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাসহ ৫৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে আসামিদের প্রায় সবাই জামিনে বেরিয়ে গেছেন। অনেকে জামিন পাওয়ার পর পলাতক থেকে আবারও সোনা চোরাচালানে যুক্ত হয়েছেন।
এই অবৈধ সোনা পাচার প্রতিরোধে বা ঠেকাতে ২০১৪ সালের জুলাইয়ে সোনার ওপর আমদানি শুল্ক ২০ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু তারপরও কোনোভাবেই যেন পাচার চক্রের সোনা পাচার থামানো যাচ্ছে না। বিমানবন্দরে বিনিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলার পরও সোনা আসছে দেদার। প্রায় প্রতিদিন না হলেও প্রতি সপ্তাহে ধরা পড়ছেই ছোট-বড় চালান।
পুলিশের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সোনা চোরাচালানের শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে ভারতে। তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের সোনা চোরা কারবারিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে। বাংলাদেশে যারা সোনা নিয়ে আসে তারা ক্যারিয়ার মাত্র। মূল হোতারা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এর আগে কয়েকজন ভারতীয় নাগরিককে পুলিশ গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে কলকাতার বাহাদুর রোডের নাগরিক দীপক কুমার আচারিয়া, ভারতের মুম্বাইয়ের লালবাগের দিনেশ মঙ্গিলাল জেন, মুম্বাইয়ের খাদাক রোডের জিগনেস কুমার সুরেশ কুমার, নেপালের কাঠমান্ডুর গাওয়াপুরের গৌরাঙ্গ রোসান ও ভারতের জেমস প্রিন্স রয়েছেন। ধরা পড়ার পর তারা জানিয়েছেন, সে দেশের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা সোনা আনতে লগ্নি করেন।
সোনা চোরাচালান মামলার তদন্ত তদারককারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শেখ নাজমুল আলমের ভাষ্য, সোনা চোরাচালান চক্রের প্রধানদের অধিকাংশকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। কিন্তু গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই জামিনে বেরিয়ে আবার সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ছেন।
জানা যায়, এ যাবত বিমানবন্দরে আটক করা সোনার কোনো মামলার বিচারসম্পন্ন হওয়ার নজির দিতে পারেনি আদালত ও পুলিশ। সংশ্লিষ্টরা শুধু মামলা দায়ের করেই খালাস। এর অধিকাংশই চার্জশীট হলেও আদালতে বিচার প্রক্রিয়াসম্পন্ন হওয়ার নজির নেই।
সোনা পাচারের নেপথ্য কারণঃ ঢাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের সোনার দোকানগুলোতে যেসব সোনা দেখা যায়, তার প্রায় সবই চোরাই পথে আসা। তবে বাংলাদেশে সোনার বাজার খুব ছোট। সেই তুলনায় প্রতিবেশী ভারতে সোনার বাজার অনেক বড়। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য বলছে, ভারতের বার্ষিক সোনার চাহিদা প্রায় দেড় শ টন। ভারতের চাহিদার সোনার একটি বড় অংশই যায় চোরাই পথে। ভারতে প্রতি এক ভরি (১১.৬৬ গ্রাম) সোনা আমদানির শুল্ক চার হাজার রুপি (৪ হাজার ৮০০ টাকা। বাংলাদেশে শুল্ক ভরিতে তিন হাজার টাকা। এই শুল্ক কর ফাঁকি দিতেই সোনা চোরাচালান হয়। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির তথ্যমতে, দেশে ১৫ হাজার জুয়েলার্সের দোকান আছে। এতে বছরে ৭ হাজার কেজির মতো সোনার চাহিদা রয়েছে। প্রবাসীদের ব্যাগেজে আনা সোনা ও পুরোনো সোনা দিয়ে বাংলাদেশের বাজার চলে।
পর্দার আড়ালের অপরাধীঃ একাধিক শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, বিমানবন্দরে কর্মরত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগসাজশে সোনার বড় চালান নির্বিঘেœ বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যায়। এ কাজে সহায়তা করেন শুল্ক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও বিমানের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ১০ তোলা ওজনের একেকটি সোনার বার বিমানবন্দর থেকে বাইরে এনে দিলে চোরাচালানিদের কাছ থেকে এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পান তারা। দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে আসার সময় বিমানের কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী সোনা পরিবহনে সহায়তা করেন। বাহকদের হাতে সোনা ধরিয়ে দেন দুবাইয়ে অবস্থানরত চক্রের প্রধানেরা। বাহক সেই সোনা বিমানের আসনের নিচে, শৌচাগারে বা অন্য কোনো স্থানে লুকিয়ে রেখে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। পরে বিমানবন্দরে কর্মরত লোকজন নিজ দায়িত্বে সেই সোনা বের করে বাইরে নিয়ে আসেন। মানি এক্সচেঞ্জের মালিকেরা সোনা হাতবদলে মধ্যস্থতা করে কমিশন পান, আবার তারা কখনো কখনো টাকা বিনিয়োগও করেন।
উল্লেখ্য, অবৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি ঠেকানোসহ এই খাতে শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে সরকার ২০১৮ সালে নীতিমালা তৈরি করে, যার মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে আমদানির সুযোগ তৈরি হয়। অন্যদিকে ব্যাগেজ রুলসেও কর পরিশোধ করে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ আনার সুযোগ রয়েছে। তবে জানা যায়, সহজে ও স্বল্প খরচে আমদানির সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও বৈধ পথে খুব বেশি স্বর্ণ আমদানি হচ্ছে না। বরং ব্যাগেজ রুলসের সুবিধা নিয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ দেশে প্রবেশ করছে।
শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করছেন, সরকারকে শুল্ককর দিলেও এই স্বর্ণের একটি বড় অংশ চোরাচালানকারীদের হাতেই যাচ্ছে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক আমদানির চাইতে ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে স্বর্ণ আনায় খরচ সাশ্রয় ও হয়রানিমুক্ত হওয়ায় জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের অনেকেই কৌশলে এ পথে স্বর্ণ আনছেন।
আইনগতভাবে এ ব্যবস্থা অবৈধ না হওয়ায় এসব স্বর্ণ আটকানোও যাচ্ছে না। বিমানবন্দরের বাইরে এসে বাহক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ইস্যুটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অবহিত করেছে ঢাকা কাস্টম হাউজ। এসব কারণে বহুল আলোচিত স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় বাজারে শৃঙ্খলা আনার সরকারি উদ্যোগও ভেস্তে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাগেজ রুলসে পরিবর্তন আনার পরামর্শ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
ব্যাগেজ রুলস অনুযায়ী, বর্তমানে যাত্রীরা বৈধ পথে ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণ বা দুটি বার (প্রায় ২০ ভরি) সঙ্গে আনতে পারেন। এর শুল্ককর ৪০ হাজার টাকা। আর নারী যাত্রীরা ১০০ গ্রাম স্বর্ণালংকার করমুক্ত উপায়ে আনতে পারেন। একজন যাত্রী কতবার এই সুযোগ নিতে পারবেন, আইনে এ বিষয়ে কিছু বলা নেই।
বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনকারী শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ‘আমরা ধারণা করছি, এসব স্বর্ণ সংশ্লিষ্ট যাত্রী কিংবা বৈধ ব্যবহারকারীদের জন্য আসছে না। শুল্ক পরিশোধ করা যাত্রীরা কেবল বাহক হিসেবে কাজ করছেন। প্রত্যেক যাত্রী দুটি স্বর্ণের বার এনে ঘোষণা দিয়ে সরকারকে ৪০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিচ্ছেন। এর বাইরে হয়তো বহন করার জন্য তিনিও কিছুটা আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন। মূলত অবৈধ উপায়ে স্বর্ণ ধরার ক্ষেত্রে ব্যাপক কড়াকড়ির কারণে চোরাচালানকারীরা এ পথটি বেছে নিচ্ছেন। কেউ হয়তো ৬০টি স্বর্ণের বার বাংলাদেশে প্রবেশ করাতে চাইছেন। তিনি এজন্য ৩০ জন যাত্রীকে দুটি করে বার দিয়ে দেবেন। এসব কাজে বিশ্বস্ত যাত্রীদের ব্যবহার করা হয়। পুরো কার্যক্রমে প্রযুক্তির সহায়তাও নেওয়া হয়। তারা বিমানবন্দরে এসে ঘোষণা দিয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় কর পরিশোধ করবে।‘
তাঁরা আরও বলেন, ‘কিন্তু বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসার পর নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় এসব স্বর্ণ হাতবদল হয়ে যায়। এ সময় যিনি বহন করে আনছেন, তাকে চুক্তি অনুযায়ী আর্থিক ‘পুরস্কার’ দিয়ে দিচ্ছেন। ঐ কর্মকর্তা বলেন, দেখা গেছে অনেক যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে, যারা ঘন ঘন বিদেশে যাওয়া-আসা করছেন। আসার সময় দুটি করে বার নিয়ে এসে ঘোষণা দিয়ে সরকারকে কর পরিশোধ করছেন, যা অস্বাভাবিক।‘
সরকারের ব্যাগেজ রুলস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সর্বশেষ ২০১৯ সালে এটি সংশোধন হয়েছে। ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে আনা স্বর্ণের বিষয়ে ‘নট ফর সেল অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন’ কথাটি লেখা থাকে। কিন্তু বাস্তবে এ ক্ষেত্রে তদারকির শক্ত কোনো আইনি কাঠামো নেই। ফলে শুল্ককর পরিশোধের কাগজপত্র কিংবা যাত্রীর পাসপোর্টের কপি রেখে জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের হাতে যাচ্ছে একটি ভালো অংশ।
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগারওয়ালা ব্যাগেজ রুলসের আওতায় আনা স্বর্ণ জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা কিনছে না বলে দাবি করেছেন। তাঁর দাবি, স্বর্ণ আমদানি নীতিমালার কিছু দুর্বলতার কারণে আমদানিকারকেরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। আমদানি করলে সব মিলিয়ে খরচ হয় সাড়ে ৩ হাজার টাকা আর ব্যাগেজ রুলসের আওতায় এলে মাত্র ২ হাজার টাকা। আবার আমদানির ক্ষেত্রে স্যাম্পল পরীক্ষার জন্য বিএসটিআর রিপোর্ট পাওয়ার আগে স্বর্ণ পাওয়া যায় না। এসব কারণে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি হচ্ছে না বললেই চলে।