নিজস্ব প্রতিবেদক:
কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো নীতিমালা না থাকায় দেশে কর্মরত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের ওপর খেয়ালখুশি মতো মোটা অংকের ফি আরোপ করছে। আইন অনুযায়ী প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থীদের ফি-বেতন নির্ধারণের এখতিয়ার রয়েছে। যদিও সেক্ষেত্রে অবশ্যই আর্থসামাজিক মানদ- বিবেচনায় নেয়ার আইনি নির্দেশনা রয়েছে। বিগত ১৯৯২ সালে দেশে বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষার যাত্রা শুরু হয়। তিন দশকে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে ১০৮টিতে দাঁড়িয়েছে। তবে বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষার গুণগত মানের আশানুরূপ উন্নতি ঘটেনি। বরং অবহেলিত থাকছে গবেষণা ও গ্রন্থাগার উন্নয়নের মতো উচ্চশিক্ষার মৌলিক বিষয়গুলো। সিংহভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ন্যূনতম অবকাঠামো ও শিক্ষক নিশ্চিত করতেই ব্যর্থ হচ্ছে। তারপরও ওসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের ওপর নিজেদের ইচ্ছেমতো ফি চাপিয়ে দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইনে দেয়া এখতিয়ারের সুযোগ নিয়েই শিক্ষার্থীদের ওপর মোটা অংকের ফি চাপিয়ে দিচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এ ফি নির্ধারণ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উহার প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের নিমিত্ত শিক্ষার্থীদের জন্য দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার মানদ-ে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি শিক্ষার্থী ফি কাঠামো প্রস্তুত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে অবহিত করিবে। কমিশন অবহিত হওয়ার পর প্রয়োজনে পরামর্শ প্রদান করবে।’ কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই শিক্ষার্থী ফি কাঠামোর বিষয়ে কমিশনকে নিয়মিত অবহিত করছে না।
সূত্র জানায়, দেশে অনুমোদিত প্রথম বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলত ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) প্রোগ্রাম ভর করেই উত্থান হয়েছে। ২০০০ সালের দিকে নর্থ সাউথে বিবিএ পড়তে একজন শিক্ষার্থীর ক্রেডিটপ্রতি ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৫৭৫ টাকা। ওই সময় রেজিস্ট্রেশন বা ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। এখন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়তে শিক্ষার্থীদের ক্রেডিটপ্রতি টিউশন ফি দিতে হয় সাড়ে ৬ হাজার টাকা। আর ভর্তি ফি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার টাকা। টিউশন ও ভর্তি ফির বাইরে গ্রন্থাগার, ল্যাব ও অ্যাক্টিভিটির মতো বিভিন্ন ফিও বহুগুণ বাড়ানো হয়েছে। তার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই যুক্ত করা হচ্ছে নতুন ফি। মূলত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নীতিমালা না থাকার সুযোগেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের ইচ্ছামতো নানা নামে মোটা অংকের ফি আদায় করছে। একদিকে মোটা অংকের টিউশন ফি, অন্যদিকে নানা নামে নতুন ফি আরোপ করা হয়। মূলত ওই বিশ্ববিদ্যঅলয়ে সবকিছুকেই বাণিজ্যিকভাবে দেখা হয়। পরিচয়পত্র বাবদ ১ হাজার টাকা ফি নেয়া হচ্ছে। আগে নন-ক্রেডিট ল্যাবের জন্য কোনো ফি দিতে হতো না। এখন সেখানেও সাড়ে ৬ হাজার টাকা করে ফি দিতে হবে। ফলে অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতি বছর আয়কৃত অর্থের কয়েকশ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। তাছাড়া শিক্ষার্থী সংখ্যার বিবেচনায় আরেক বড় বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ২০১০-১১ সালের দিকে একজন শিক্ষার্থীর সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক পড়তে সব মিলিয়ে খরচ হতো ২ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এক দশকের ব্যবধানে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। অন্যান্য প্রোগ্রামের ক্ষেত্রেও প্রায় একই হারে টিউশনসহ অন্যান্য ফি বেড়েছে। বিবিএ ও বিএসসি প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে ফির পরিমাণ আরো বেশি হারে বাড়ানো হয়েছে। নর্থ সাউথ ও ড্যাফোডিলের মতোই গত এক দশকে দফায় দফায় ফি বাড়িয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
এদিকে ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে টিউশনসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের শিক্ষার্থী ফি যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে সুপারিশ করা হয়। শিক্ষার্থী ফি বিষয়ে কমিশনের ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি ও টিউশন ফি এবং শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বিষয়ে ভিন্নতা ও অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের ট্রান্সক্রিপ্ট, সার্টিফিকেট ও প্রশংসাপত্র ইত্যাদি সরবরাহ করার ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চহারে ফি নিয়ে থাকে। এমনকি কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই প্রতি বছর টিউশন ও ভর্তিসহ অন্যান্য ফি বাড়ানোর অভিযোগও পাওয়া যায়। যেহেতু দেশের সব অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থা সমান নয়, সেহেতু শিক্ষার্থীদের প্রদেয় বিভিন্ন ফি ও চার্জ একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দিতে পারে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ জানান, বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরই টিউশন ফি যৌক্তিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে একটি অবস্থানে চলে এসেছে, তারা শিক্ষার্থীদের ওপর মোটা অংকের ফি আরোপ করছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এত বেশি ফি নিচ্ছে যে প্রতি বছর তাদের তহবিলে কোটি কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকছে। তাই ইতোমধ্যে ইউজিসি মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করে এ-সংক্রান্ত কিছু সুপারিশ করেছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ