জেলা প্রতিনিধি, পটুয়াখালী (কলাপাড়া) :
গাছটি নামে গোলগাছ হলেও দেখতে আসলে গোল নয়। এটি কিছুটা নারিকেল পাতার মতো। প্রতিটি গোলগাছ পাতাসহ উচ্চতা হয় ১২ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত। এর ফুল হয় হলুদ এবং লাল বর্নের। ফুল থেকে ফল (গাবনা) পরিপক্ব হলে সেটি তালগাছের আঁটির মতো কেটে শাস খাওয়াও যায়। এটি প্রকৃতি নির্ভর পাম জাতীয় উদ্ভিদ। নোনা জলে এর জন্ম, নোনা সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। অথচ এর ডগা থেকে বেড়িয়ে আসছে সু-মিষ্ট রস। সেই রস দিয়ে তৈরি হচ্ছে গুড় (মিঠা)। সুস্বাদু এই গুড়ের চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক। এসব গাছ পটুয়াখালীর কলাপাড়াসহ দক্ষিণাঞ্চলের নদী কিংবা খালের পাড়ে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয়। কিন্তু জলবায়ুর প্রভাবজনিত কারণ ও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ আর চাষাবাদের অভাবে এ গাছ ক্রমশই ধ্বংস হতে বসেছে বলে পরিবেশবীদরা জানিয়েছেন।
স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট গোল গাছের মালিকরা জানান, গোলগাছ চাষাবাদ অত্যন্ত লাভজনক, সহজসাধ্য এবং ব্যয়ও খুব কম। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। করতে হয় না কোনো পরিচর্যা। এক সময় বিভিন্ন খাল-বিল ও নদীর তীরে প্রচুর গোলের বাগান দেখা যেত। কিন্তু আগের মত নেই সেই গোল বাগন। শীত মৌসুমে গোলবাগানের মালিকরা এর রস দিয়ে গুড় উৎপাদন করে বাড়তি অর্থ উপার্জন করে থাকেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের সর্ববৃহৎ বনাঞ্চল সুন্দরবনসহ দক্ষিণ উপকূলের বিভিন্ন স্থানে গোলগাছ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া, কুয়াকাটা, রাঙ্গাবালি, গলাচিপা, দশমিনা, বাউফল, বরগুনার আমতলী, তালতলী, পাথরঘাটা, ভোলা ও খুলনা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাসহ চরাঞ্চলে গোলগাছের বাগান রয়েছে। তবে ব্যাক্তি মালিকানাধীন এ উপজেলায় ব্যাপক গোল বাগান রয়েছে। বন বিভাগের উদ্যোগে গত ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৯০ সি: কিলোমিটার এলাকায় গোলবাগান করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাকৃতিক দূর্যোগে কিছু বাগান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৫০ হাজার সি: কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গোলবাগান করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
গোলের রস থেকে গুড় উৎপাদন এলাকা উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সূর্য ওঠার সাথে সাথে কৃষকরা রস সংগ্রহ করতে ছুটে যায় গোলবাগানে। কেউ কলস কিংবা বালতি নিয়ে যাচ্ছে। অবার কেউ রস ভর্তি কলস বালতি নিয়ে বাড়ি ফিরছে। সংগ্রহীত গোলের রস বাড়ির উঠানে গৃহবধূরা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ছেঁকে ঢোঙ্গায় রাখছেন। এরপর তারা তাফালে খড়কুটার আগুন জ্বালিয়ে রস দিয়ে তৈরি করেন গুড় বা মিঠা।
ওই গ্রামের সুনিতি রানী বলেন, বিয়ের পর থেকে গোলের রস দিয়ে গুড় তৈরি করছি। আগে অনেক বেশি গুড় হতো। এখন কমে গেছে। অপর এক গৃহবধূ বিথীকা রানী বলেন, এখন রস জ্বাল দিতে হবে। এখন কথা বলার সময় নেই। একটু বসতে হবে। এমন কর্মযজ্ঞ ওই গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙিনায়।
নবীপুর গ্রামে গোল গাছ চাষি নিঠুর হাওলাদার বলেন, তার বাগানে ৩০০ শতাধিক গোলের ছড়া হয়েছে। সূর্য ওঠার সাথে সাথে তিনি কলস নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন বাগানে। শুরু হয় প্রতিটি গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ। এভাবেই প্রতিদিন দুই দফা রস সংগ্রহ ও ছড়া কাটতে হয় তার। চৈত্র মাস পর্যন্ত চলবে এ কর্মযজ্ঞ। একই গ্রামের পরিমল হাওলাদার বলেন, ছোট ছোট হাঁড়ি অথবা প্লাস্টিকের পাত্রে ফোটা ফোটা জমানো রস দিয়ে তৈরি হয় গুড়। গোলগাছের গুড়ের স্থানীয় বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গত বছরের চেয়ে তার বাগনে এ বছর ফলন ভাল হয়েছে। ২৫০ টি ছড়া বর্তমানে ৭ কলশ রসে প্রায় ১১ কেজি গুড় তৈরি হয়। মনোজ শিকারি বলেন, ৩০০ ছড়ার মধ্যে এ পর্যন্ত ১০০ থেকে ১৫০ ছড়া কাটতে পেড়েছেন। বাকিগুলো কয়েক দিনের মধ্যে কাটা শুরু করবেন বলে তিনি জানান।
বন বিভাগের কলাপাড়া সহকারী রেঞ্জ মো. মঞ্জুর কাদের বলেন, বনবিভাগের উদ্যোগে এ উপজেলার চাকামইয়া, নীলগঞ্জ ও টিয়াখালীর ইউনিয়নের লোন্দা গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে গোলগাছের বীজ রোপণ করা হয়েছে। সেগুলো ভালই হয়েছে। এ বছর আরও গোল গাছের বাগন করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি