নিজস্ব প্রতিবেদক :
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পিলারে বারবার ফেরির ধাক্কা উদ্বেগে ফেলেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে। এসব ধাক্কা কেবলই দুর্ঘটনা, নাকি ইচ্ছেকৃত, তা নিয়েও চলছে বিতর্ক। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের ধাক্কা এড়াতে ফেরি চলাচলে রুট স্থানান্তরের কথা ভাবছে সরকার। এ ক্ষেত্রে ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের গোপালপুর ও ঢাকার দোহারের মৈনট ঘাটকে ফেরি চলাচলের বিকল্প রুট হিসেবে বিবেচনা করার দাবি তুলেছেন এলাকাবাসী। বিগত সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সরেজমিনে রুট পরিদর্শনের কথাও বলছেন তারা। এলাকাবাসী বলছেন, গোপালপুর-মৈনট ঘাট এলাকা পরিদর্শনের পর কার্যক্রম থমকে গেছে। এখন যেহেতু পদ্মা সেতুর পিলারে ধাক্কায় ফেরির রুট স্থানান্তরের আলোচনা সামনে এসেছে, সেক্ষেত্রে গোপালপুর-মৈনটকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা সদরের গোপালপুর থেকে ঢাকার দোহার উপজেলার মৈনট রুটে বর্তমানে ফেরি ছাড়া লঞ্চ, ট্রলার, স্পিডবোটসহ অনেক নৌযান চলাচল করে।
ফরিদপুরের নগরকান্দা, সদরপুর ও ভাঙ্গা উপজেলাসহ আশপাশের এলাকার হাজারো যাত্রী প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গোপালপুর-মৈনট নৌরুট দিয়েই যাতায়াত করেন। এ নৌপথ দিয়ে যাত্রীরা স্পিডবোটে মাত্র ২০ মিনিটে পদ্মা নদী পার হতে পারেন। মৈনটে উঠেই যাত্রীরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঢাকা পৌঁছাতে পারেন। তাই এ অঞ্চলের ঢাকাগামী যাত্রীদের বেশিরভাগই গোপালপুর-মৈনট ঘাট দিয়ে পদ্মা নদী পার হন। এলাকাবাসী বলছেন, এ রুটে ফেরি চলাচল শুরু হলে ফরিদপুর ও ঢাকার পাশাপাশি সুফল ভোগ করবে গোপালগঞ্জ, নড়াইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জ জেলার কোটি মানুষ। বিশেষ করে এই রুট দক্ষিণ পশ্চিমের অনেক জেলার সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব কমিয়ে দেবে। এলাকাবাসী মনে করেন, এ রুট চালুর জন্য শুধু প্রয়োজন পদ্মা নদীতে ড্রেজিং, সংযোগ সড়ক চওড়া এবং ঘাট নির্মাণ করা।
দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গোপালপুর-মৈনট রুটে ফেরি চলাচলের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি এলাকা পরিদর্শন করেন তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব পংকজ কুমার। সেদিন তিনি জানান, এই রুটে ফেরি চলাচল শুরু হলে ঢাকার দোহার ও ফরিদপুরের যাতায়াত ব্যবস্থার আরও উন্নতি হবে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু চালু হলে কোন রুটে ফেরি চলাচল সহজ হবে এ বিষয়েও আলোচনা করেন পংকজ কুমার।
পরদিন ১ ফেব্রুয়ারি গোপালপুর-মৈনট এলাকা ঘুরে দেখে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) একটি প্রতিনিধি দল। তাদের সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী। পরে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় জরিপ করে এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে এই রুটে ফেরি চালুর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সময় নিক্সন চৌধুরী বলেন, ফেরি ঘাটটি চালুকরণের বিষয়টি আমার নির্বাচনী ওয়াদা। পুরো প্রক্রিয়া শেষের পথে। আগামী মাস (মার্চ) থেকে সি-ট্রাক ও ৪-৫ মাসের মধ্যে ফেরি চালু হবে। এতদিন এই অঞ্চলের মানুষের যে ভোগান্তি হতো তা লাঘব হবে। তবে সেই পরিদর্শন কার্যক্রমের পর করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রকোপ দেখা দেয় দেশে। তারপর থমকে যায় এই রুটে ফেরি চলাচলের আলোচনাও।
এই রুটে ফেরি চলাচল চালুর ব্যাপারে চরভদ্রাসন উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মো. ফয়সাল হাসান শাওন বলেন, এ পাড় ফরিদপুরের চরভদ্রাসন-গোপালপুর, অপর পাড় ঢাকার দোহার-কার্তিকপুর এলাকা। এ পাড়ের যাত্রীরা নদী পার হয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা পৌঁছাতে পারেন। সেজন্য এই অঞ্চলের ঢাকাগামী বেশিরভাগ যাত্রী গোপালপুর-মৈনট ঘাট দিয়ে পদ্মা নদী পার হন। ফয়সাল হাসান শাওন বলেন, এ রুটে ফেরি চলাচলের ব্যবস্থা করলে প্রথমে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। অন্যদিকে দুই পাড়ের মানুষেরও সময়-অর্থ সাশ্রয় হবে। উপকৃত হবে দুই পাশের ৮-১০ জেলার মানুষ। এমনকি গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইলসহ বেশ কয়েকটি জেলা থেকে রাজধানীসহ পূর্বাঞ্চলের বাজারে পণ্য পাঠানোও সহজ হবে। ইজারাদার হিসেবে গোপালপুর-মৈনট ঘাট পরিচালনা করেন দোহারের মাহমুদপুর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মো. আবুল কাশেম। তিনি বলেন, ঘাটটি আমার মামা আবদুল আলিম মৃধার নামে ছয় কোটি ৩৫ লাখ টাকায় ইজারা নেওয়া, আমি পরিচালনা করি। বছরখানেক আগে এমপি নিক্সন চৌধুরী ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা কয়েক বার এ ঘাট পরিদর্শন করেন। ড্রেজার দিয়ে বালু কাটাও শুরু হয়। তখন বেশ জোরালোভাবে শুনলাম এ পথে ফেরি চালু হবে। তারপর যে কেন বন্ধ হয়ে গেল তা বলতে পারবো না। চরভদ্রাসন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আজাদ খান বলেন, বিকল্প ফেরিঘাট হিসেবে এই রুটটি চালু করতে এলাকাবাসীর পক্ষে সরকারের কাছে বিনীতভাবে দাবি জানাই। এ বিষয়ে চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোতালেব মোল্যা বলেন, গোপালপুর-মৈনটঘাট রুটে ফেরি চালু হলে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পিলারের সঙ্গে ফেরির ধাক্কা এড়ানো যাবে। পাশাপাশি মানুষের সময় ও অর্থ বাঁচবে। ব্যবসায়ী ও কৃষকদের জন্যও বিপ্লব ঘটবে, কারণ চরাঞ্চলের অবহেলিত কৃষক কখনোই তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। তিনি মনে করেন, দুই পাশের রাস্তা সংস্কার আর ফেরি ঘাট স্থাপন করলেই দ্রুত সময়ের মধ্যে এ রুটে ফেরি চলাচলের ব্যবস্থা করা সম্ভব। চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মাসুম রেজা বলেন, এটা একটা জাতীয় ইস্যু। আমি অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকলেও এ বিষয়ে আমার পক্ষে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) অতুল সরকার বলেন, আগে ওখানে যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে ফেরি চালু করার উপযোগী কি-না। রাস্তা-ঘাটসহ অন্যান্য বিষয় সরেজমিনে দেখে-জেনে-বুঝে তারপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতুর পিলারে ২৩ দিনের মধ্যে চারবার ধাক্কা খেয়েছে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের বাংলাবাজার রুটে চলাচলকারী ফেরি। সবশেষ গত ১৩ আগস্ট সকালে বাংলাবাজার ঘাট থেকে শিমুলিয়া ঘাটে আসার পথে কাকলি নামে একটি ফেরি সেতুর ১০ নম্বর পিলারটিতে ধাক্কা দেয়। গত ৯ আগস্ট একই পিলারে ধাক্কা খায় আরেকটি ফেরি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ আগস্ট ওই নৌরুট এবং ঘাট এলাকা পরিদর্শনে যান নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। সেখানে তিনি জানান, বারবার ফেরির ধাক্কার পর সেতু এড়িয়ে ফেরি চলাচলের জন্য ঘাট স্থানান্তরের চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন পেলে ঘাট স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। দেশের এই স্বপ্নের সেতুর পিলারে প্রথমবার ধাক্কা লাগার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি সেতুর নিচ দিয়ে ফেরি চলাচল বন্ধের সুপারিশ করেছিল। এজন্য ঘাট স্থানান্তর করা দরকার বলেও মত দিয়েছিল তারা। ওই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর আরও তিনবার ধাক্কা লাগার ঘটনা ঘটল।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম