নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। শিল্পকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া এবং বর্জ্যে বিপন্ন পরিবেশ, নেতিবচক জলবায়ুর কারণে হুমকিতে পৃথিবী। এটি নিয়ে বিশ্বজুড়েই চলছে আলোচনা-সমালোচনা। সংকট মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগও আছে বিভিন্ন দেশের। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে করেছে বাংলাদেশ। পোশাক উৎপাদনে পরিবেশসহায়ক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সবুজ কারখানা এখন বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। যার সংখ্যা ১৫০টি। সর্বোচ্চ মানের শিল্পকারখানার বিবেচনায়ও বাংলাদেশ এগিয়ে। বিশ্বে সর্বোচ্চ মানের ১০০ কারখানার মধ্যে ৪৩টিই এ দেশে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থানে থাকা অন্য দেশগুলো হচ্ছে- ইটালি, আয়ারল্যান্ড, মেক্সিকো, পোল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া। অর্থাৎ সবুজ ও পরিবেশবান্ধব শিল্পের দৌড়ে উন্নত ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোকেও টেক্কা দিচ্ছে বাংলাদেশ।
এরইমধ্যে বাংলাদেশের দেড়শ কারখানা পেয়েছে লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন (লিড) সনদ। অপেক্ষায় আছে আরও ৫৭৫টি কারখানা। এছাড়া, পোশাক খাতের বাইরে চামড়াজাত পণ্য এবং বৈদ্যুতিক ফ্যান তৈরির দুটি কারখানা লিড সনদ পেয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গ্রিন অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছে এপেক্স ফুটওয়্যার। পোশাকসহ ছয়টি ক্যাটাগরিতে এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। অন্য খাতগুলো হচ্ছে- প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, চা শিল্প, চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক ও ওষুধ শিল্প। অর্থাৎ পোশাকের বাইরে অন্যান্য খাতেও সবুজ কারখানা গড়ে উঠছে।
সবুজ কারখানার আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতি সনদ দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবি)। ১৯৯৩ সাল থেকে এটি দেওয়া হয়। বাণিজ্যিক ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িসহ অন্যান্য স্থাপনার ক্ষেত্রেও এই সনদ দেয় ইউএসজিবি। শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে পণ্য উৎপাদন পর্যন্ত ছোট-বড় সব পর্যায়ে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি কতটা মানা হলো- তার চুলচেরা বিশ্নেষণ করে এ সনদ দেওয়া হয়। দেশে নতুন বিনিয়োগের অনেক কারখানাই এখন সবুজ প্রযুক্তিতে নির্মাণ হচ্ছে। সবুজ কারখানায় রূপান্তরের চেষ্টা করছে পুরোনো বেশ কিছু কারখানাও। লিড সনদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হলে পোশাক খাতের এই সবুজ বিপ্লব বিশ্বে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে।
লিড সনদের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবেশ সুরক্ষা এবং সবুজ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সাশ্রয়ী উৎপাদন। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বিদেশি বড় ব্র্যান্ড এবং ক্রেতার আস্থা বাড়ে এতে। ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষিতে এগিয়ে থাকা যায়। দেশের এবং পোশাক খাতেরও ব্র্যান্ড ইমেজ বাড়ে। এসব কারখানায় সাধারণত দুর্ঘটনা হয় না। প্রাকৃতিক আলো-বাতাসেই চলে উৎপাদন। কারখানার ভেতর সার্বক্ষণিক সহনীয় তাপমাত্রা থাকে। কাজের পরিবেশ থাকে নিরাপদ, আনন্দদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত। নবায়নযোগ্য জ¦ালানি ব্যবহারের সুবিধায় পানি, বিদ্যুৎ কম খরচ হয়। বর্জ্য নিঃসরণ কম হওয়ায় এর শোধন প্রক্রিয়ার ব্যয়ও কম হয়। সর্বোপরি দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন ব্যয় কমে আসে। এ ছাড়া সবুজ কারখানায় উৎপাদিত পোশাকের গায়ে একটি গ্রিন ট্যাগ থাকে। সচেতন ভোক্তাদের কাছে এর উচ্চ কদর রয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার দেশের পোশাক খাতের চেহারা বদলে দিয়েছে। নতুন বেশিরভাগ কারখানাই এ প্রক্রিয়ায় নির্মিত হচ্ছে। এতে প্রাথমিক ব্যয় বেশি হলেও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ছে। করোনায় গত প্রায় দুই বছর নতুন বিনিয়োগ প্রায় স্থবির ছিল। এ কারণে সবুজ প্রযুক্তির সম্ভাব্য অনেক বিনিয়োগ দৃশ্যমান হয়নি। এখন করোনার প্রভাব কাটিয়ে পরিস্থিতি আবার অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সবুজ প্রযুক্তির নতুন কারখানা নির্মাণে আরও বিনিয়োগ হবে বলেও আশা করেন তিনি।
এদিকে, একটি সাধারণ কারখানা নির্মাণে যে পরিমাণ বিনিয়োগ লাগে, সবুজ প্রযুক্তিতে তা নির্মাণে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ হয়। তারপরও কেন উদ্যোক্তারা সবুজ প্রযুক্তিতে ঝুঁকছেন- এ বিষয়ে লিড সনদের সর্বোচ্চ ক্যাটাগরি প্লাটিনাম পাওয়া আদমজী ইপিজেডে অবস্থিত ইউএইচএম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন ও এর অভিঘাতের জন্য প্রধানত প্রচলিত শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। পরিবেশ বিপন্ন করে শিল্প উৎপাদনের প্রচলিত ব্যবস্থা বেশি দিন টিকতে পারবে না। আগাম এই ধারণা থেকেই উদ্যোক্তারা সবুজ শিল্পে ঝুঁকছেন। সম্প্রতি জলবায়ু সম্মেলনে কয়েকটি ব্র্যান্ড এবং ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বলেছে, যেসব কারখানা সবুজ প্রযুক্তিতে গড়ে ওঠেনি, ২০৩০ সালের পর সেসব কারখানা থেকে আর পোশাক নেবে না তারা। কাজ হারানোর এই ঝুঁকি নেই সবুজ কারখানায়।
ইউএসজিবিসির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, সাধারণ একটি কারখানার তুলনায় লিড সনদ পাওয়া কারখানার জ¦ালানি সাশ্রয় ২৪ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ। পানির ব্যবহার কম হয় ৪০ শতাংশ। বর্জ্য উৎপাদন কম হয় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কম হয় ১৩ শতাংশ। একটি রেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে কারখানার নকশা, নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর লিড সনদ দেওয়া হয়। ছোট বিষয়কেও গুরুত্ব দিয়ে বিশ্নেষণ করা হয়। যেমন, শুধু কারখানার অবস্থান সূচকেই ২৬ রেটিং পয়েন্ট বিবেচনা করা হয়। স্থানীয়দের সহজ যাতায়াত, পরিবহন ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক আলো-বাতাস ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও পয়েন্ট রয়েছে।
এরকম ১১০ পয়েন্টের মধ্যে ৮০ পয়েন্টের ওপরের কারখানাকে প্লাটিনাম সনদ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে প্লাটিনাম সনদ পাওয়া কারখানা ৪৩টি। ১০০ পয়েন্টও পেয়েছে একটি কারখানা। তবে ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে কারখানাটির নাম প্রকাশ করা হয়নি। রেটিং পয়েন্ট ৬০ হলে গোল্ড ক্যাটাগরির সনদ দেয় ইউএসজিবি। এ ক্যাটাগরিতে ৭৮ পয়েন্ট পেয়েছে দেশের একটি কারখানা। তবে কারখানাটির নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। দেশে গোল্ড ক্যাটাগরির কারখানার সংখ্যা ৯২টি। সিলভার ক্যাটাগরির ক্ষেত্রে রেটিং পয়েন্ট ৫০ থেকে ৫৯ এর মধ্যে। দেশে এই মানের কারখানা ৯টি। এ ছাড়া শুধু লিড সনদ পাওয়া কারখানার সংখ্যা চারটি।
এদিকে, পরিবেশ রক্ষায় সবুজ কারখানা নির্মাণে উৎসাহিত করছে সরকার। চলতি অর্থবছর পোশাক খাতে করপোরেট কর ১২ শতাংশ। এর মধ্যে সুবজ কারখানা হিসেবে সনদপ্রাপ্ত কারখানার জন্য এ হার ১০ শতাংশ। স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাস্টেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগের মহাব্যবস্থাপক খন্দকার মোর্শেদ মিল্লাত বলেন, সবুজ প্রযুক্তি শিল্পকারখানায় অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪০০ কোটি টাকার একটি তহিবল আছে। স্বল্প সুদে এই তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। উদ্যোক্তাদের যদি আরও অর্থের প্রয়োজন হয়, সে জন্য ২০ কোটি ডলারের সংস্থান রাখা আছে। ঋণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ করা হয়েছে। তবে এত সুবিধা দেওয়ার পরও ৩০ শতাংশ ঋণ অবণ্টিত আছে। কারণ, অনেক উদ্যোক্তা হয়তো এই সুবিধা সম্পর্কে জানেন না। এ বিষয়ে উদ্যোক্তাদের অবহিত করা প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ