May 6, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, December 10th, 2023, 8:27 pm

পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতের বাণী বদলে গাওয়ায় সমালোচনার ঝড়

অনলাইন ডেস্ক :

বদলে ফেলা হলো রবীন্দ্রনাথের গান। কবিগুরুর লেখা বাণী বদলে গাওয়া হলো পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সংগীত হিসেবে। আর তাতেই তৈরি হয়েছে ক্ষোভ, উঠেছে প্রশ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন তার কালজয়ী গান। সেই রবীন্দ্রসংগীত ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।’ এই গানকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসংগীত হিসেবে গাওয়া হয়েছে কয়েকটি শব্দ বদলে।

রবির গানে বদল
গানের বাণীতে আছে বাঙালি। রাজ্যসংগীতে সেটা হল বাংলা। গত মঙ্গলবার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে গানটি গাওয়া হয়। গান গাইবার আগে দর্শকদের উঠে দাঁড়াতে বলা হয়। তারপর যে গান বিশিষ্ট শিল্পীরা পরিবেশন করেন, তা সুরে-কথায় একেবারে সেই চেনা রবীন্দ্রসংগীত। কিন্তু বদল শুধু শেষ স্তবকে। মূল গানে থাকা ‘বাঙালির পণ, বাঙালির আশা’ এবং ‘বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন’ অংশটিকে ‘বাংলার পণ, বাংলার আশা’, ‘বাংলার প্রাণ, বাংলার মন’ করে গাওয়া হয়েছে বলে রেকর্ডিংয়ে শোনা যাচ্ছে। এই পরিবর্তন উৎসবের জমাটি আবহে সেভাবে নজর কাড়েনি। পরে তা নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা। গানটির পরিবেশনায় ছিলেন রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী এবং গায়ক ইন্দ্রনীল সেন, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, রূপঙ্কর বাগচী, ইমন চক্রবর্তী, মনোময় ভট্টাচার্য, অদিতি মুন্সীরা। মঞ্চে তখন উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও উপস্থিত ছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।

বদলের প্রস্তাব
কয়েকমাস আগে এ ধরনের পরিবর্তনের একটি প্রস্তাব শোনা গেছে। বদল করা যায় কি না, সেটা জানতে চেয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তবে বিভিন্ন স্তরে এই নিয়ে আপত্তি থাকায় পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। রাজ্য সরকার জানিয়ে দেয়, গানটির শব্দে পরিবর্তন আনা হবে না। ৭ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় রাজ্যসংগীত সংক্রান্ত বিল পাশ হয়। গত সোমবার বিধানসভা মিউজিয়ামে উদ্বোধনের সময় এই গান গাওয়া হয়েছিল। চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে এই গান পরিবেশিত হওয়ার পর তা নিয়ে চলছে সমালোচনা। মুখ্যমন্ত্রী বলার পরও কীভাবে পরিবর্তিত গানকে রাজ্যসংগীত হিসেবে গাওয়া হল, তা নিয়ে বিস্ময় ও প্রশ্ন জেগেছে। গানের শিল্পীরা এ ব্যাপারে স্পষ্ট উত্তর দেননি। কেউ বলেছেন কী গেয়েছেন মনে নেই! আবার কারও বক্তব্য, কাগজে যা লেখা ছিল, তাই গেয়েছেন!

কঠোর প্রতিক্রিয়া
ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলার সংগীত ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষেরা। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার বলেন, “এটা অপকর্ম৷ ক্ষমতার অপব্যবহার যে-ই করেছে, তাদের আমি তীব্র ধিক্কার জানাই। ইতিহাস নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। এই গানে রবীন্দ্রনাথ কথা লিখেছেন, সুর দিয়েছেন। এটা বদল করা যায় না।”ডয়চে ভেলেকে বিশ্বভারতীর আশ্রমিক সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রবি ঠাকুর গান নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা পছন্দ করতেন না। সেটা তিনি নিজেই বলেছেন। তার পরও এই পরিবর্তন কাম্য নয়।”শিল্পী ও গবেষক শুভেন্দু মাইতি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বদলে গাওয়া এক ধরনের রাষ্ট্রীয় ঔদ্ধত্য। সকলের প্রতিবাদ করা উচিত। যে শিল্পীরা এই গান গাইলেন, তারা কেন প্রতিবাদ করলেন না? তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত। দেড়শ বছর ধরে বাঙালি রবীন্দ্রনাথের গান শুনছেন, গাইছেন। ভোটে জিতেছি বলে সেটা পাল্টে দিতে পারি না।”

প্যারোডি পরম্পরা
অবশ্য পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, প্যারোডি তৈরি ও বাণীর ইচ্ছেমতো পরিবর্তন কি এক?
সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘এই পরিবর্তনকে আমি সমর্থন করি না। রবীন্দ্রনাথের গান নজরুল ও দ্বিজেন্দ্রলাল পরিবর্তন করে প্যারোডি করেছিলেন। কিন্তু সেটা প্যারোডিই ছিল। তার মাধ্যমে কখনো বার্তা দেওয়া হত, কখনো বা নিছক ব্যঙ্গ বা হাস্যরস তৈরির চেষ্টা থাকত। রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দ বদলে দিলে সেটা রবীন্দ্রসংগীত থাকে না। তা হলে রাজ্যসংগীতের জন্য নিজেদের গান তৈরি করতে হতো।”

রবীন্দ্র থেকে নজরুল
সম্প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের গানে পরিবর্তন করায় সমালোচনার মুখে পড়েন বিখ্যাত ভারতীয় সুরকার এ আর রহমান। একটি ছবিতে ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি ভিন্ন সুর সংযোজনায় ব্যবহার করা হয়। তীব্র প্রতিবাদ জানান শিল্পীদের একাংশ। পরে ভুল স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেছে ছবির নির্মাতারা। কবিগুরুর সৃষ্টি আর এখন স্বত্বের অধীন নয়। তাই বলে তার যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে মাঝেমধ্যেই। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসংগীতের অধ্যাপক রুমা মিত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যে কোনো গান তার গীতিকার বা সুরকারের সম্পদ। সৃষ্টিকে বিকৃত করার অধিকার কারো নেই। এটা অনধিকার চর্চা। স্রষ্টা কী ভেবে গানে ওই কথা লিখেছেন, সেটা যারা পরিবর্তন করছেন, তারা কি জানেন? পরিবর্তন করার ফলে কি খুব ভালো জিনিস তৈরি হলো? এ নিয়ে আরও আলোচনা হলে এমন বিকৃতি এড়ানো যায়।” রবীন্দ্রনাথের গানের বদল নিয়ে তেমন প্রতিবাদ অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। আলোচনা পুরোটা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘‘বাঙালি এখন মেরুদ-হীন জাতি। তাদের সব প্রতিবাদ ওই ফেসবুক আর সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রতিবাদ করতে বাড়ির বাইরে বেরোতে হয় না, রাস্তায় নামতে হয় না।”