November 18, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, March 24th, 2024, 3:48 pm

পানিশূন্য তিস্তা: ধ্বংসের মুখে জীববৈচিত্র্য

নিজস্ব প্রতিবেদক , রংপুর:

চৈত্র মাসের শুরুতেই পানি শুকিয়ে বালুচরে পরিণত হয়েছে খরস্রোতা তিস্তা। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে চর। হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য। বর্ষা এলেই বন্যা আর ভাঙনের মুখে পড়েন তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা। ভাঙন আর প্রবল স্রোতে ভেসে যায় তিস্তা পাড়ের মানুষের ফসলি জমি, বসতভিটাসহ সব স্থাপনা। আর শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়। হেঁটেই পার হওয়া যায়। নদীর পাড়ে নেই নৌকা, মাঝি-মাল্লাদের হাঁকডাক। নেই জেলেদের মাছ ধরার ব্যস্ততা। এ যেন নিরাশার বালুচরে থমকে গেছে তিস্তাপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা। চরাঞ্চলে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন হচ্ছে।

নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে নদীর দুই পাশে বাঁধ দিয়ে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি করলে তিস্তা ফিরে পাবে চিরচেনা রূপ।
জানা যায়, ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিস্তা নদী। এরপর লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে। নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার।

উজানে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে প্রতিবেশী দেশ ভারত একতরফা নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। ফলে পানির অভাবে বাংলাদেশ অংশের লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ১২৫ কিলোমিটার তিস্তার অববাহিকায় জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়েছে। দেশের অন্যতম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে বালুচর পড়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ফলে ব্যারাজ, তিস্তা রেলসেতু, সড়ক সেতু ও গঙ্গাচড়া শেখ হাসিনা তিস্তা সড়ক সেতু দেখে মনে হয় যেন এগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে ধু ধু বালুচরে।

নদী পাড়ের জেলেরা জানান, এক সময় তিস্তায় প্রচুর মাছ ধরা পড়তো। সেই মাছ বিক্রি করেই তারা সংসার চালাতেন। সেই সময় তিস্তার মাছকে ঘিরে সদর উপজেলার তিস্তা বন্দরে শুঁটকির আড়ত ছিল। যেখান থেকে সারাদেশে যেত তিস্তা নদীর শুঁটকি। এখন মাছই পাওয়া যায় না। তাই শুঁটকির অভাবে তিস্তা বন্দরের আড়তেরও নেই আগের জৌলুস। যা আছে তা বাইরের শুঁটকি। পানি শূন্য তিস্তায় মাছের আকাল পড়েছে। অনেক জেলে পেশা পরিবর্তন করেছেন। যারা রয়েছেন তাদের সংসার চলে অনাহারে-অর্ধাহারে।

তিস্তার বাম তীরে সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নের পাঙ্গাটারী গ্রামের জেলে জীতেন্দ্রনাথ বলেন, আগে এ নদীতে দিনভর মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার সুখেই চলত। মাছের শুঁটকি করেও সারা বছর বিক্রি করতাম। এখন নিজের খাবার মাছও পাওয়া যায় না। আশপাশের গর্তে থাকা মাছ ধরে কোনরকম খেয়ে, না খেয়ে কাটছে দিন।

জানা যায়, ১৯৭৯ সালে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৯০ সালে শেষ হয়। সেই সময় ব্যারাজ নির্মাণে ২,৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রধান প্রকৌশলীর বরাত দিয়ে তিস্তার বামতীর রক্ষা কমিটি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে যে টাকা খরচ হয়েছে তার ৫ শতাংশ খরচ করলে তিস্তা ব্যারাজ থেকে কাউনিয়ার তিস্তা রেল সেতু পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটারে প্রটেক্টিভ বাঁধ দেওয়া যেত।

এর সত্যতা মেলে ব্যারাজ প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শনে। সেখানে এক্সেভেটর, বুলডোজারে নদীশাসনসহ নদীসংশ্লিট কোটি টাকার মালামাল অযতেœ পড়ে আছে। এসব অকেজ ও বহু পুরোনো যন্ত্রপাতি সাধারণ মানুষের কাছে পিকনিক অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। এদিকে তিস্তা নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বর্ষায় একটু পানি হলেই পাড় উপচে পড়ে। বর্ষার সময় নির্ধারণ করা নদীর বিপৎসীমা রের্কড পরিবর্তন হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড লালমনিরহাট দপ্তর জানান, গত ৫ বছরে তিনবার রেকর্ড পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমানে বিপৎসীমা ৫২.৬০ সেন্টিমিটার করা হয়েছে।

জানা যায়, নদীর প্রবাহমাত্রা ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি থাকা প্রয়োজন ১৯ হাজার কিউসেক। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন প্রায় ১৪ হাজার কিউসেক। আর নদীর অস্তিত্ব বাঁচাতে প্রয়োজন আরও পাঁচ হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু শুকনো মৌসুমে তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না। অন্যদিকে বর্ষায় গড়ে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার কিউসেক পানি আসে। এই পানি লালমনিরহাট অংশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরির্বতন হয়ে বারবার ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনের ফলে নদীর প্রস্থ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার। কিন্তু দুই এ প্রস্থ কিলোমিটার থাকার কথা।
ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্ট থেকে দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর, বগুড়াসহ পানি সরবরাহের জন্য করা ক্যানেলের আওতায় থাকা এলাকাতে চাষের জন্য পানি দিতে গেলে আরও ২৮০০ কিউসেক পানি লাগবে। ভরা মৌসুমে এই ক্যানেলগুলোতে সর্বোচ্চ ২২০০ কিউসেক পানি ছেড়ে দেওয়া হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসরণ অধিদপ্তর সূত্র জানান, লালমনিরহাটে চরকেন্দ্রিক ৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সব্জিসহ বিভিন্ন ফসল চাষ হয়। এর মধ্যে ভুট্টার পরিমাণ সব থেকে বেশি। কিন্তু এসব চরে অপরিকল্পিতভাবে সড়ক, বাজারঘাট-বাড়ি ও নানা কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদের প্রকল্পের কারণে নদী হারিয়েছে প্রাকৃতিক রূপ।
তিস্তা গবেষকরা বলছেন, এক দিকে ভারত পানি প্রত্যাহার করছে, অন্যদিকে আমরাও পানি প্রত্যাহার করছি। এটি আন্তঃসীমান্ত নদী হওয়ায় পানি বণ্টন করতে হবে। প্রয়োজনে হতে হবে আন্তর্জাতিক আদালতের দারস্থ।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার জানান, বর্তমানে ২০০০ কিউসেক পানি রিজার্ভ আছে। এই ২০০০ কিউসেক পানি তিস্তা নদী থেকে নিয়ে ক্যানেলে সরবরাহ করা হয়েছে। নদী সচল রাখতে ৪৪ গেটের মধ্যে ২টি গেট ৬ ইঞ্চি করে খুলে রাখা হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে বাকি সব গেট বন্ধু থাকে। ক্যানেলগুলো লিজ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৩০ শতাংশ জমির ধান চাষে মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকা গুনতে হয় কৃষককে।
তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকল্প এ নদীকে বাঁচাতে পারে। বাঁচাতে পারে নদীর দুই পাড়ের মানুষদের। তখন নদী হয়ে উঠবে এই অঞ্চলের জীবন রেখা, এমনটাই মনে করছেন নদী বিশেষজ্ঞরা।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিধপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো: ওবায়দুর রহমান মন্ডল জানান রংপুর বিভাগের বিশেষ করে রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা জেলার চরাঞ্চলে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন হচ্ছে। এ ফসল রফতানি হচ্ছে শ্রীলংকা, জাপান, সিঙ্গাপুর, মধ্যপ্রাচ্যেসহ বিভিন্ন দেশে। এতে করে এসব অঞ্চলের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে, আর কৃষকেরা সচ্ছলভাবে তাদের জীবন যাপন করছেন।