আবুল কালাম আজাদ :
পাবনার ঐতিহ্যবাহি চলনবিল ও গাজনার বিল অঞ্চলের শুটকির চাতাল থেকে চলতি মৌসুমে প্রায় সোয়া ২কোটি টাকার উপরে শুটকি মাছ বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলের শুটকি নীলফামারি জেলার সৈয়দপুর হয়ে ভারত, দুবাইসহ মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। দেশীয় জাতের ছোট মাছ বেশী শুকানো হয়ে থাকে। বর্তমানে মাছ শুকানোর চলছে ভরা মৌসুম। জেলার চলনবিল অধ্যুষিত চাটমোহর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া উপজেলার বিভিন্ন বিল ও নদী পাড়ে এবং সুজানগর উপজেলার গাজনার বিল পাড়ে প্রায় অর্ধশত শুটকির চাতাল রয়েছে।
বর্ষাকালে অপার সৌন্দর্য্যরে লীলাভুমি হিসেবে পরিচিত ঐতিহ্যবাহি চলনবিল। বর্ষা মৌসুমে সৌন্দর্য পিপাসুদের হাতছানি দিয়ে ডাকে তার সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য। সৌন্দর্যের পাশাপাশি চলনবিলে রয়েছে মৎস্য ভান্ডার। বর্ষা মৌসুমে চলনবিলকে ঘিরেই এখানকার হাজার হাজার পারিবার মাছ ধরে তাদের জীবনজীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। বিশেষ করে কার্তিক মাসের দিকে বর্ষার পানি চলে যাওয়ার সময় প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। আর তখনই এই বিলের রাস্তার পাশে নদীর তীরে সুবিধা মতো স্থানে গড়ে ওঠে ছোটো, বড় বিভিন্ন ধরনের শুটকির চাতাল। চলে মাঘ মাস পর্যন্থ।
পাবনা জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলনবিল ও গাজনার বিলসহ জেলায় ৭ হাজার ৯শ’ হেক্টর বিল ও জলাশয় রয়েছে। এছাড়া সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে জেলায় ৭ হাজার ৯৫৫ হেক্টার জমিতে ছোট বড় বিভিন্ন পুকুর রয়েছে। এসব পুকুর ও জলাশয়ে প্রতি বছর বিপুল পরিমান মাছ উৎপাদন করা হয়েছে থাকে। বিশেষ করে চলনবিলসহ বিভিন্ন উন্মুক্ত জলাশয়ে বর্ষার মৌসুনে প্রচুর পরিমান দেশীয় জাতের ছোট মাছ পাওয়া যায়। এসব মাছে পাবনা অঞ্চলের চাহিদা পুরুন করেও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়ে থাকে। বর্ষার শেষে কার্তিক মাস থেকে শুকানো হয়ে থাকে বিভিন্ন জাতের মাছ।
জেলার চাটমোহর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, সুজানগর উপজেলায় চলনবিল ও গাজনার বিলসহ জেলার বিভিন্ন বিল, জলাশয় ও নদীর পড়ে প্রতি বছর গড়ে উঠে ছোট বড় ৪০টি শুটকির চাতাল। চলতি বছর জেলায় ৪৩ হাজার মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় ১৬টি উপজেলার বুক জুড়ে রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম চলনবিল। বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে নানান প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। পুরো বর্ষা মৌসুমে এই চলনবিলে চলে মৎস শিকারীদের মাছ ধরা। এসব বিলে ধরা পড়ছে পুটি, শোল, টাকি, মৌসি, টেংড়া, সিং, গুচি, বোয়াল, মাগুড়, কৈ, চাঁদা, খলিসা, চিতল, মৃগেল, মোয়া, বৌমাছ, গোপুয়ে, বেলেসহ (অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন নাম রয়েছে এসব মাছের) নানান প্রজাতির মাছ রয়েছে। আর এই মাছকে কেন্দ্র করে চলনবিল ও গাজনার বিল পাড়ের সুবিধামতো স্থানে গড়ে উঠেছে শুটকির চাতাল। শুটকির মৌসুমে এসব চাতাল গুলিতে শতশত শ্রমিক কাজ কারে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন।
সম্প্রতি ভাঙ্গুড়া উপজেলার কলকতি গুমানী নদীর তীরে, চাটমোহর উপজেলার বোয়ালমারি খলিশাগাড়ি বিল ঘুরলে সেখানে শুটকি মাছের একাধিক চাতাল মাছ শুটকি করতে দেখা যায়। কথা হয় একাধিক চাতাল মালিকের সাথে। তারা জানান, কার্তিক মাস থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত এই সকল এলাকায় প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। পুটি মাছ আকার ভেদে ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্রয় করেন তারা। প্রতি মণ মাছে তিন থেকে চার কেজি লবণ লাগে। আবহাওয়া ভালো থাকলে শুকাতে প্রায় চারদিন সময় লেগে যায়। প্রায় তিনমণ মাছ শুকিয়ে একমণ মাছ হয়। শুকানো মাছ ট্রাকযোগে সৈয়দপুরে নিয়ে আকার ভেদে প্রতিমণ শুটকি ২ হাজার টাকা থেকে ১৮ হাজার টাকা পযর্ন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। সৈয়দপুর থেকে এই অঞ্চলের শুটকি ভারতে রপ্তানি হয়ে থাকে।
ভাঙ্গুড়া এলাকার চাতাল শ্রমিক জমির উদ্দীন বলেন, শুটকি মৌসুমে বিভিন্ন চাতালে চার থেকে ছয় জন বা আরো বেশি শ্রমিক কাজ করে থাকেন। এসব শ্রমিকদের মাসিক বেতন ছয় থেকে পনেরো হাজার পর্যন্ত। চাটমোহর উপজেলার খলিশাগাড়ি বিল পাড়ের চাতাল মালিক বৃদ্ধ আব্দুর রহমান বলেন, এই মৌসুমে তারা বিলপাড়ে চাতালের পাশেই অবস্থান করেন এবং মাছ ক্রয় করে শুটকির চাতাল করে মাছ শুকিয়ে থাকেন। এ কাজ প্রায় ২৫ বছর ধরে করছেন। তবে এবছর মাছের পরিমান অনেকটাই কম।
চাটমোহর উপজেলার নটাবাড়ীয়া গ্রামের শুটকি চাতাল মালিক আরশেদ আলী জানান, স্থানীয় হাট-বাজারে শুটকি বিক্রয় হয়না। শুটকির চাতাল থেকেই বস্তায় পুরে ট্রাক যোগে সৈয়দপুরে নিয়ে বিক্রিয় করতে হয়। এ অঞ্চলে শুটকির আরোত থাকলে আমরা একটু লাভবান হতাম। তাহলে আমাদেরকে আর সৈয়দপুর কষ্ট করে যেতে হতো না।
পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, পাবনার চলনবিল ও গাজনার বিল এলাকায় ছোট জাতের মাছ বেশি শুটকি করা হয়ে থাকে। শুটকির মৌসুমে আমরা চাতাল মালিকদের বিভিন্ন ভাবে পরামর্শ দিয়ে থাকি। এ সময় মাছ শিকারি এবং শুটকি চাতালে অনেক সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ বছর অঞ্চল থেকে প্রতি বছর ৪৩ হাজার মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় সোয়া ২ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি