April 19, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, December 28th, 2021, 8:30 pm

পুঁজিবাজারে উত্থান-পতন চলছে কারসাজি চক্রের ইশারায়

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ধুঁকে ধুঁকে মরছে। দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারীদের অর্থের যোগানদাতা দেশের পুঁজিবাজার নিজস্ব শক্তিমত্তা নিয়ে আজো গড়ে উঠতে পারেনি। সবক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা এবং দুঃশাসন দমন করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি নিয়ে গড়েই উঠতে পারেনি দেশের এই বাজার। উন্নত থেকে শুরু করে উদীয়মান- সব পুঁজিবাজারেই উত্থান-পতন হয়। এক বছর উত্থান হয় তো পরের বছরই পতন। এক শেয়ারের দাম বাড়ে তো আরেক শেয়ারের দাম কমে।
আসলে এটি নির্ভর করে কোম্পানির পরিচালন দক্ষতা ও মুনাফার ওপর। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি কেতাবি নিয়ম। কারসাজিই এই বাজারের শেয়ারের দাম উত্থান-পতনের মূল কারণ। কারসাজির কারণে ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম তলানিতে থাকে আর মন্দ কোম্পানির শেয়ার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, বাজারকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। আর বিভিন্ন সময়ে যারা কারসাজিতে যুক্ত তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সূত্র জানায়, কারসাজি চক্রের ফাঁদে পড়ে মুনাফার আশায় লগ্নি করা বিনিয়োগকারীরা মূল পুঁজি হারাতে বসেছেন। গুটিকয় স্বার্থান্বেষী তাদের টাকা লুটেপুটে খাচ্ছে। গত দেড় বছরে হাতেগোনা কয়েকটি চক্র নিজেরা কেনাবেচা করে ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করতে নানা গুজব ছড়িয়ে দর বাড়িয়েছিল। এর কেন্দ্রে একজন সরকারি কর্মকর্তা। সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও প্রলুব্ধ হয়ে যখন শেয়ার কিনেছেন এবং দর বেড়েছে, তখন ওই চক্র তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে ক্রমাগত দর হারাচ্ছে শেয়ারগুলো।
বাজার সূত্রে জানা যায়, এ চক্রটি বীমা কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ানোর মধ্য দিয়ে গত বছর জুলাইয়ে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি করেছিল। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হন। পরে সাধারণ ছোট মূলধনি ও কম বাজারদরি অন্য অনেক শেয়ারের দর বাড়িয়ে মুনাফা নিয়ে সটকেও পড়েছে। কিছুদিন আগে এ চক্রের হাতে পড়ে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দর মাত্র তিন সপ্তাহে ১২ টাকা থেকে ২০ টাকা ছাড়িয়েছিল। চক্রটি মুনাফা নিয়ে বের হওয়ায় যেভাবে শেয়ারটির দর বেড়েছিল, ঠিক সেভাবে দাম কমে আগের জায়গায় ফিরেছে। এর আগে ১০ টাকা দরের এনআরবিসির মতো নতুন ব্যাংকের শেয়ারদরও ৪০ টাকায় তুলেছিল। গত নভেম্বরের শুরুতেও শেয়ারটির দর ৪০ টাকা ছিল; এখন যা ২৫ টাকায়। এ চক্রের হাতে এখনও ফরচুন শুজ, জেনেক্স ইনফোসিস, ডেল্টা লাইফ, সোনালী পেপারের শেয়ার রয়েছে। এখন এসব শেয়ারই নিজেরা সার্কুলার ট্রেড করে শেয়ার লেনদেন বাড়িয়ে রেখেছে।
যেকোন বিষয়ে অনিয়ম হলে এর বিপরীতে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বিচার কার্যক্রম দ্রুত শেষ হবে- এমন প্রত্যাশা সবারই থাকে। বিশেষ করে পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানি কিংবা পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট যে কারো বিরুদ্ধে কারসাজি কিংবা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠলে তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধান করা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দায়িত্ব্য। কারণ এতে কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর ভাগ্য জড়িত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন যে বিষয়টি, তা হলো বাজার তথা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার বিষয়টি। যদি বিনিয়োগকারীরা বাজারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে, তবে তা বাজারের অস্থিতিশীলতার মূল নিয়ামক হয়ে ওঠতে পারে।
দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে তদন্তের নামে কালক্ষেপন একটি নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থ্যাৎ তদন্ত শব্দটি নতুনরুপে ‘ত-দ-ন্ত’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে, পুঁজিবাজারে অনিয়মে বিপরীতে গঠিত কমিটির তদন্ত কার্যক্রম। আর এ কারণেই কারসাজি কিংবা আইন লঙ্ঘণ করে কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের হাড়ি বোঝাই করলেও বরাবর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীরা। এতে বাজারে আস্থার সঙ্কটেরও সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
কারসাজি চক্রের বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আচরণও বাজারে অস্থিরতা ছড়াচ্ছে বলে জানা গেছে। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরের শেষে এসেও ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যতটা সম্ভব মুনাফা বাড়াতে শেয়ার বিক্রি করেছে; এরপর হাত গুটিয়ে বসে আছে। এই বসে থাকার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু ইস্যুর প্রভাব আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ ব্যাংককে শেয়ারবাজার-সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে ব্যাংকের বিনিয়োগে খুব বেশি খবরদারি না করা। নানা রকম ইস্যুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শেয়ারবাজারের বিপরীতে দাঁড় করানোর চেষ্টাও আছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদেরকেও দোষারোপ করছেন। তাঁদের মতে, শেয়ার বাজারে ১০ লাখের বেশি সক্রিয় বিনিয়োগকারী থাকলেও হাজার জনকেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ, যারা নিজের বোধ-বুদ্ধি ব্যবহার করে শেয়ার কেনেন। এরা কারসাজি চক্র কী শেয়ার কিনছে, তা দেখে শেয়ার কেনেন। প্রতিষ্ঠানগুলোও তাই। এখন বড়রা নিষ্ক্রিয় থাকায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কোন শেয়ার কিনবেন, কোনটা বিক্রি করবেন- এ দিশা পাচ্ছেন না। এ কারণে কয়েক মাস ধরে অস্বাভাবিক আচরণ করছে শেয়ারবাজার। হঠাৎ বড় উত্থান হচ্ছে, পরদিনই বড় পতন হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পতনই হচ্ছে বেশি।
এটি স্পষ্ট যে, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যেভাবে শেয়ারদর ও সূচক বেড়েছে, তার যৌক্তিক কোনো কারণই ছিল না। কৃত্রিমভাবে বাড়ানো শেয়ারদর টেকসই হয় না। কখনও দায়িত্বশীল সংস্থা থেকে ব্যাংককে বিনিয়োগ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কখনও বলা হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে ক্রয়মূল্যে এক্সপোজার হিসাব করতে; কখনও অর্থ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হচ্ছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হবে বলে প্রচার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, শেয়ারবাজারের ভবিষ্যৎ ভালো। দায়িত্বশীলরা আগ বাড়িয়ে কথা বলায় বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো অবশ্য জানায়, শেয়ারবাজার এখন পুরোপুরি কৃত্রিমভাবে চলছে। কমিশনের জ্ঞাতসারেই এটা হচ্ছে। এখনকার লেনদেনের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ লেনদেন হচ্ছে গুটিকয় ব্যক্তি ও তাদের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে। তারা নিজেদের মধ্যে শেয়ার কেনাবেচা করে লেনদেন বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের মতো কারসাজি চক্র বেপরোয়া। তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা জড়িয়ে পড়েছেন কারসাজিতে। অনেক প্রভাবশালীও শেয়ার কেনাবেচা করছেন। এসব জেনেও কী করে তা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তা না করে উল্টো কারসাজি চক্রের হাতে একের পর এক ব্রোকারেজ লাইসেন্স তুলে দিচ্ছে বিএসইসি। গত দেড় বছরে তিনটি ব্রোকারেজ প্রায় ২০০ কোটি টাকা নিয়ে সটকে পড়েছে।
তবে কমিশনের কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েও কারসাজি চলছে। যেমন উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নূন্যতম শেয়ার থাকা, অযথা বোনাস লভ্যাংশ প্রদান নিরুৎসাহিত করা, বন্ধ কোম্পানির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া, কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ন্যূনতম পর্যায়ে উন্নীত করা। কমিশনের এসব সিদ্ধান্তকে পুঁজি করে আবার কেউ কেউ কারসাজির ফাঁদও পাতছে। এসব জেনেও কমিশন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাদের ভয়- ব্যবস্থা নিতে গেলে বাজারে আরও দরপতন হয়।