নিজস্ব প্রতিবেদক:
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই উন্নয়নমূলক অনেক প্রকল্প গ্রহণ করে। যার অনেকগুলোর কাজ নির্ধারিত সময়ে বা কিছুটা বেশি সময় নিয়ে চললেও শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তবে অনেক প্রকল্প রয়েছে যেগুলো ঝুলে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। বারবার মেয়াদ বাড়ানোর কারণে কাজ থমকে থাকার পাশাপাশি এসব প্রকল্পে বাড়ছে ব্যয়ও। ফলে ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য, বাড়ছে জনদুর্ভোগ। জানা গেছে, সরকারি অর্থ ছাড় বন্ধ, নির্মাণ সামগ্রীর চড়া বাজারদর, মূল্য সমন্বয় না করা, ঠিকাদারদের বকেয়া বিল পরিশোধ না করা এবং ডলার সংকটে নির্মাণ সামগ্রী আমদানি করতে এলসি খোলায় সমস্যা হওয়ায় চলমান প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার ১,০১৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের বেশিরভাগের কাজেই স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এছাড়া মহামারি-উদ্ভূত বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক সংকট এবং ইউরোপে চলমান যুদ্ধের ফলে উন্নয়ন খাতে কৃচ্ছ্রতা সাধনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সরকারকে। এখন কয়েক লাখ কোটি টাকার হাজারের অধিক এরকম প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসব চলমান প্রকল্পের মধ্যে প্রায় ৬০ শাতংশ প্রকল্পের কাজ এখন প্রায় বন্ধ। সরকারের সাত সংস্থার অধীনে বাস্তবায়ন হচ্ছে এসব প্রকল্প। এর মধ্যে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার ২৪৫টি প্রকল্পের ৫৩ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে, যা সাত সংস্থার মধ্যে সর্বোচ্চ। আর সবচেয়ে কম অগ্রগতি হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৯১টি প্রকল্পে। পাউবোর এ প্রকল্পগুলোর সার্বিক অগ্রগতি ২৩ শতাংশ। অন্য পাঁচটি সংস্থা হলো-স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), গণপূর্ত বিভাগ, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। এই স্থবিরতা কত দিনে কেটে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ সম্পন্ন হবে, সেটি নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। জানা গেছে, উদ্বোধনের দ্বারপ্রান্তে এসে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ খরচ বেড়ে যায় ৩১৫ কোটি টাকা। একই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদও বৃদ্ধি করা হয়। এর মধ্যে আবার ঠিকাদারের বিল পরিশোধসহ বিভিন্ন আমদানি খাতে খরচ বাড়ে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা। ফলে সব মিলিয়ে এখন এ প্রকল্পে খরচ হবে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। প্রকল্পটি শেষ করার জন্য এর আগে সময় দেওয়া হয়েছিল ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি যখন পাস হয়, তখন এই প্রকল্পের খরচ ছিল আট হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা, মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। পরে যথাসময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম দফা সংশোধন করে খরচ ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। মেয়াদ বাড়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখন আবার খরচ বাড়ানো হচ্ছে। এই প্রকল্পে অর্থ দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। যদিও প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে ও ব্যয় কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘দ্রুত কাজ করেন। খরচ কম করেন। তবে খরচ বন্ধ করা যাবে না। একান্ত প্রয়োজনীয় ব্যয় করতেই হবে।’ তবে প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনাও নতুন নয়। দেশের টাকা সাশ্রয় করে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ আগেও একাধিকবার দিয়েছেন তিনি। অথচ প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনা সংশ্লিষ্টরা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। জানা গেছে, জানুয়ারির মাঝামাঝি একটি একনেক বৈঠকেও ১১টি প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ছয় মাসে মোট ১৭৫টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১২১টি প্রকল্পের প্রতিবেদন জারি করে সভা করা হয়েছে এবং ৫৪টি প্রতিবেদন ঝুলে আছে। সাধারণত ব্যয় ব্যতিরেকে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ। এ ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি করতে হলে অনুমোদন লাগে একনেক সভার। চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত আটটি একনেক সভা হয়েছে। সভাগুলোতে নতুন এবং সংশোধনী মিলিয়ে মোট ৩৯টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ২৪টি মেয়াদ বাড়ানোর সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব প্রকল্পে কয়েক দফায় মেয়াদ বেড়েছে এক থেকে আট বছর পর্যন্ত। মেয়াদ বাড়ানোর কারণে প্রকল্পগুলোতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া আরও ৮ থেকে ১০টি প্রকল্পের মেয়াদ এবং ব্যয় বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ করা হয়েছে পরবর্তী একনেকে। এর বাইরে আরও কিছু প্রকল্পের মেয়াদ এবং ব্যয় বাড়ানোর সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন পায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ৩৮টি প্রকল্প। তাতে ৪০ হাজার ৯২০ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে বার বার প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, আমরা চেষ্টা করছি, দ্রুত সময়ে যাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। সংশ্লিষ্ট সচিব ও প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে বৈঠক করবো। আমাদের দিক থেকে চেষ্টা করছি। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়নে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করি। প্রকল্পে সময় বাড়লে সম্পদের অপচয় হয়। আবার প্রকল্পের কার্যকারিতাও কমে যায়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলছে, দ্রুত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন যেন হয়, মেয়াদ যাতে না বাড়ে, সেজন্য চেষ্টা করছে তারা।
আরও পড়ুন
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
কমতে শুরু করেছে কুড়িগ্রামের নদীর পানি, ভাঙন আতঙ্কে মানুষ
দিনাজপুরে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় নিহত ২