April 19, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, August 30th, 2022, 9:04 pm

প্রায় ৩০ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে রসিকের ব্যাংক হিসাবে

আব্দুর রহমান মিন্টু, রংপুর :

উদাসীনতা ও পছন্দের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে না পারায় গত অর্থ বছরের সরকারি বরাদ্দের প্রায় ৩০ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের (রসিক) ব্যাংক হিসাবে। স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় সিটি করপোরেশন এলাকায় উন্নয়নের জন্য ওই অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এদিকে অর্থবছর শেষ হওয়ায় বরাদ্দের অব্যবহৃত টাকা সরকারি কোষাগারে টাকা ফেরত না দেওয়ায় গত ১০ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে আইএমইডি (বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ)।

নিয়ম অনুযায়ী একটি প্রকল্পের বরাদ্দ করা অর্থ সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের নির্দ্দিষ্ট সময়ে খরচ করতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। ফলে সরকার উন্নয়নের জন্য টাকা বরাদ্দ দিলেও তা রংপুর সিটি কের্পোরেশন নির্দিষ্ট প্রকল্পখাতে ব্যয় করতে পারেনি। তা সরকারি কোষাগারে ফেতর দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা করেনি সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ।

নিয়মানুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ খরচ করতে না পারলে ওই অর্থবছর শেষ হওয়া মাসের অব্যয়িত টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে হয়। কিন্তু তা না করে সরকারি টাকা নিজেদের ব্যাংক হিসাবে রেখে দিয়েছে রংপুর সিটি করপোরেশন।

‘রংপুর সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসন ও অবকাঠামো উন্নয়ন (প্রথম সংশোধিত)’ নামক প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শন করে এমন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। খরচ না বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হলে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন শেষে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

আইএমইডি জানায়, প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ২১০ কোটি টাকা। সরকার প্রকল্পটির অনুকূলে কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী সব টাকা ছাড় করে। অর্থবছর শেষে কর্তৃপক্ষ সবমিলিয়ে ১৮০ কোটি টাকা খরচ করতে পেরেছে। অর্থবছর শেষে বাকি ৩০ কোটি টাকা সরকারকে ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এই ৩০ কোটি টাকা এখন পর্যন্ত হস্তান্তর না করে প্রকল্পের হিসাবে জমা রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে আইএমইডি।

প্রকল্পটি জুন ২০১৮ থেকে জুন ২০২২ মেয়াদে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু এই সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে না পারায় জুন ২০২৩ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে কর্তৃপক্ষ।

আইএমইডি জানায়, বর্তমানে প্রকল্পটি আরও এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সেক্ষেত্রে মেয়াদ বৃদ্ধি করে প্রকল্পের কাজ কীভাবে শেষ করা হবে অথবা কীভাবে অর্থায়ন করা হবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনবাসীর বর্তমান ভয়াবহ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন জলাবদ্ধতা নিয়ে একই সাথে ড্রেন, ফুটপাত, কালভার্ট ও সড়কের নির্মাণ কাজ না করায় নগরবাসীকে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। এর পর সরকার রংপুরের উন্নয়সের টাকা বরাদ্দ দিলেও তা ব্যয় করা হয়নি। তা নিয়ে রহস্য দেখা দিয়েছে।

আইএমইডি কর্মকর্তারা জানান, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের টাকা হস্তান্তর না করা এবং এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। যেহেতু গত অর্থবছরের ৩০ কোটি টাকা এখনও প্রকল্পের হিসাবে রাখা হয়েছে, সেহেতু সিটি কর্পোরেশন বা কর্তৃপক্ষের এই টাকা আর ফেরত দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা নেই। কারণ এই ৩০ কোটি টাকা যদি প্রকল্প হিসাবে থাকে, তাহলে বছর শেষে বিশাল একটা মুনাফার ভাগ পাবে সিটি কর্পোরেশন ও কর্তৃপক্ষ। এই ভাবনা থেকেই হয়তো তারা টাকাটা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি।

এ নিয়ে জানতে চাইলে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজম আলী বলেন, আইএমইডি থেকে এরইমধ্যে দু’একটি বিষয় জানতে চেয়েছে। আইএমইডি জানতে চেয়েছে এই প্রকল্পটি চলতি অর্থবছরের এডিপিতে কেন ওঠেনি এবং আমাদের কিছু অব্যয়িত টাকা কেন সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি।

আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে সিটি কর্পোরেশন প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও চলতি অর্থবছরে অর্থ চাওয়া হয়নি। কারণ প্রকল্পের অব্যয়িত সব অর্থ বর্তমানে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে। এখন প্রকল্পের মেয়াদ যদি বাড়ে তাহলে সিটি কর্পোরেশন কাজ শেষে আগামী জুনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল কোথা থেকে দেবে? এটা থেকেই বলা যায়, প্রকল্প কর্তৃপক্ষের হিসাবে রাখা অর্থ থেকেই বছর শেষে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল দেওয়া হবে। তবে বিল দেওয়ার আগে বছরব্যাপী ব্যাংকে রাখা ৩০ কোটি টাকার বিশাল মুনাফা হাতিয়ে নেবে রংপুর সিটি করপোরেশন! তা একপ্রকার দুর্নীতির ভিন্ন রুপ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি এবং সরেজমিন পরিদর্শনে আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৪টি ওয়ার্ক প্যাকেজের মধ্যে ১১টির শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ২৩টির কাজ চলমান রয়েছে। যার ভৌত অগ্রগতি প্রায় ৯০ শতাংশের মতো। ২৩টি প্যাকেজের কাজ সমাপ্ত না হওয়ার কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, বড় ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার লক্ষ্যে অনেকগুলো ছোট ছোট স্কিম একসঙ্গে করে প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে। টেন্ডার ডকুমেন্ট বিশ্লেষণে দেখা যায়, মো. খায়রুল কবির রানা নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান একাই ১০টি প্যাকেজের কাজ পেয়েছে এবং কেকেধার-আরবিএস জেভি নামক প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ৪টি প্যাকেজের কাজ। একেকটি প্যাকেজের আওতায় ৭ থেকে ১০টি করে স্কিম থাকায় একক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমীন মিঞার দেয়া আইএমইডি’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে মাঠ পর্যায়ে তদারকির অভাব ছিল। যার ফলে প্রকল্পটি যথাসময়ে সমাপ্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বাড়ছে। প্রকল্পের অগ্রগতির তথ্যে দেখা যায় চলতি বছরের ফেব্রæয়ারিতে কাজের সময় শেষ হলেও প্যাকেজ-১১ এর অগ্রগতি বর্তমানে ০ শতাংশ। গত বছরের নভেম্বরে কাজের মেয়াদ শেষ হলেও প্যাকেজ-১৮ এর অগ্রগতি বর্তমানে ২৫ শতাংশ এবং প্যাকেজ-২১ এর অগ্রগতি ২১ শতাংশ। এই তিনটি প্যাকেজের কাজের ধীরগতির বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আইএমইডিকে জানায় প্যাকেজ তিনটি শিগগিরই বাতিল করা হবে।

জানা যায়, প্রকল্পটি জুন ২০১৮ থেকে জুন ২০২২ মেয়াদে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু এই সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে না পারায় জুন ২০২৩ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে কর্তৃপক্ষ।

প্রকল্প পরিচালক ও রংপুর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজম আলী বলেন, ‘আইএমইডি থেকে এরইমধ্যে দু’একটি বিষয় জানতে চেয়েছে। আইএমইডি জানতে চেয়েছে এই প্রকল্পটি চলতি অর্থবছরের এডিপিতে কেন ওঠেনি এবং আমাদের কিছু অব্যয়িত টাকা কেন সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হচ্ছেন আমাদের তহবিল পরিচালনার দাবিদার। আমরা জাস্ট প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করি। তহবিলটা তারা দেখেন। আমাদের পিডিদের আর্থিক বা প্রশাসনিক কোনো ক্ষমতা নেই। সিটি কর্পোরেশনের কোনো পিডির আর্থিক বা প্রশাসনিক পাওয়ার নেই।’

টাকাটা বর্তমানে কার অ্যাকাউন্টে আছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপাতত প্রকল্পের অ্যাকাউন্টে টাকাগুলো রয়েছে। এই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলার কোনো ক্ষমতা আমার কাছে নেই। সুতরাং এই টাকার যদি কোনো মুনাফা হয়েও থাকে তাহলেও আমার জানার বা তোলার ক্ষমতা থাকবে না। এই অ্যাকাউন্টের যা কিছু হবে সবকিছুই ওনাদের দু’জনের এখতিয়ার।