April 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, January 14th, 2022, 6:59 pm

ফুটপাথ কি পথচারীদের না-কি হকারদের জন্য

ফাইল ছবি

অনলাইন ডেস্ক :

‘ফুটপাথ’ একটি ইংরেজি যৌগিক শব্দ। ফুট অর্থ পা, আর পাথ অর্থ পথ। অর্থাৎ পায়ে চলার পথই হলো ফুটপাথ। কিন্তু ঢাকা শহরের ফুটপাথগুলোতে যেন পা ফেলার জায়গা নেই। নানাভাবে এগুলো দখলকৃত। ইদানীং শুরু হয়েছে মোটর বাইকের দৌরাত্ম। পায়ে চলার ফুটপাথে প্রায়শ মোটরবাইক চলতে দেখা যায়। এ নিয়ে ফুটপাথ দিয়ে চলা মানুষকে পোহাতে হচ্ছে অস্বস্তি। বাইকের ধাক্কা খাওয়ার শঙ্কা।
ঢাকার যানজট নিরসনে সরকারের নেয়া উদ্যোগের সবগুলো প্রকল্পেই ফুটপাতকে মুক্ত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে যানজট নিরসনে ৯টি ফ্লাইওভার, ৬৬টি ফুটওভার ব্রিজ, ৩টি আন্ডারপাস নির্মাণ, ২০ জোড়া ডেমু ট্রেন, ৯টি ওয়াটার বাস, বিআরটিসির ৪২টি আর্টিকুলেটেড এবং ৩০৩টি ডাবল ডেকার বাস কেনা হয়েছে। চালু করা হয়েছিল অটোমেটিক সিগনালিং ব্যবস্থা ও লেন পদ্ধতি। এতে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। অথচ ফুটপাতকে মুক্ত করা যায়নি। যানজটেরও উন্নতি হয়নি। বরং দিন যতো যাচ্ছে যানজটের ভয়াবহতা ততোই বাড়ছে।
রাজধানীর প্রায় সব ফুটপাথই হকারদের দখলে। হকারদের কারণে ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন কর্মব্যস্ত মানুষ, শিক্ষার্থী, নারী ও শিশুরা। চলতে গেলেই সব সময় বিপাকে পড়তে হয় তাঁদের। ফুটপাত আর রাস্তার একাংশ দখল করে, অর্থাৎ হাঁটার অধিকারকে তোয়াক্কা না করে হকারদের ব্যবসা করাটা সবার গা সওয়া হয়ে গেছে। মুখে না বললেও প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকেরা কার্যত এটি মেনেও নিয়েছেন। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে কিছুদিন পরপরই ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ অভিযান হয়। পথচারীরা দু-তিন দিন একটু স্বচ্ছন্দে চলাচল করেন। তারপর আবার আস্তে আস্তে আগের অবস্থা ফিরে আসে।
সুশীল সমাজের অভিমত, ফুটপাতে হকারদের বেপরোয়া আচরণজনিত এই বিশৃঙ্খল অবস্থাটি নতুন নয়। অনেক বছর ধরেই এ অবস্থা চলে আসছে। প্রশ্ন ওঠে, এই হকাররা সবার চোখের সামনে এত দুঃসাহসী হয়ে উঠছেন কী করে? বিধিভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে পথচারীদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে সিটি করপোরেশন ও পুলিশের এত অনীহা কেন? তাহলে সাধারণ নাগরিকেরা কি তাঁদের কাছে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক? হকার উচ্ছেদের প্রসঙ্গ এলে অনেকে গরিব মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসেন। তাঁরা ভুলে যান ফুটপাত হাঁটার জন্য। তাঁরা ভুলে যান এটি দখল করে কেউ রুটি-রুজির সংস্থান করতে বসলে তার বিরোধিতা করাই বিধেয়। শহরবাসী হকারমুক্ত ফুটপাতে হাঁটার অধিকার চাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তাঁদের এই চাওয়াকে ‘গরিবের রুটি-রুজির বিরোধিতা’ হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টাটিই ‘রাজনীতি’।
তবে এটাও ঠিক দরিদ্র মানুষের জীবিকা অর্জনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। কিন্তু রাস্তা বা ফুটপাত দখল করে সেই জীবিকা নিশ্চিত করা অনুমোদন করা যায় না। গরিবের জীবিকার অধিকারকে স্বীকার করা আর যথেচ্ছাচার মেনে নেওয়া এক কথা নয়। ফুটপাতের ওপর হকারের অধিকার যদি মানতে হয়, তাহলে যুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি ফুটপাতের প্রতিটি ইঞ্চির ওপরই সেই অধিকার মেনে নিতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশে একজন হকারও ফুটপাতে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতে চাইবেন, ততক্ষণ তাঁকে সে জায়গাটি ছেড়ে দিতে হবে। সেই দাবি যদি না মানা হয়, তাহলে ফুটপাতের ওপর কারও দাবি মানারই প্রশ্ন আসে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় ২৯২ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে, উত্তর সিটিতে আছে ২২৩ কিলোমিটার। অভিজাত এলাকার সামান্য অংশ বাদ দিলে পুরো শহরের অধিকাংশ ফুটপাতের অবস্থাই মোটামুটি একই। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণের অবস্থা বেশি খারাপ। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গুলিস্তান, ফুলবাড়ীয়া, পল্টন, বায়তুল মোকাররম, জিপিও, মতিঝিল, দিলকুশা, আরামবাগসহ আশপাশের বিরাট এলাকাজুড়ে ফুটপাতের এক ইঞ্চিও খালি নেই। সবই হকারদের দখলে। এই বিশাল দলদারিত্বকে ঘিরে সক্রিয় চিহ্নিত চাঁদাবাজচক্র। যারা প্রতিদিনই ফুটপাতের হকারদের কাছে থেকে চাঁদা তুলছে। দিন শেষে এই চাঁদার পরিমান প্রায় ৬ লাখ টাকা। হকাররা জানায়, গুলিস্তান-মতিঝিল-পল্টন এলাকার ফুটপাতের সেই আগের চাঁদাবাজরাই বহাল আছে। শুধু পল্টন এলাকার দুলালকে বাদ দিয়ে আলাউদ্দিন ওরফে কোটনকে পুলিশের ক্যাশিয়ার নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এলাকাভিত্তিক ফুটপাথ থেকে চাঁদা তোলার জন্য বিশেষ গ্যাং আছে। এসব গ্যাং ফুটপাথ হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলে। এরা সবাই চিহ্নিত কিন্তু তাঁদের ব্যাপারে প্রশাসনকে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। সূত্র জানায়, মতিঝিল শাপলা চত্বর সংলগ্ন সোনালী ব্যাংক প্রধান শাখার সামনে ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে মকবুল। প্রতিটি দোকান থেকে দিনে দুশ’ টাকা করে দিতে হয় মকবুলকে। উল্টো দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের পাশে সেনাকল্যাণ ভবনের সামনের ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে হারুন ওরফে গাঞ্জুটি হারুন। আলিকো ভবনের সামনে থেকে চাঁদা তোলে সাদেক। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষিণের দখলকৃত ফুটপাত ও রাস্তা থেকে চাঁদা তোলে আজাদ। রুপালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের সামনে থেকে চাঁদা তোলে তাজুর ছেলে বাবলু এবং দিলকুশা বলাকা চত্বরের ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে মান্নান ও নুর ইসলাম। হকাররা জানায়, ব্যস্ত এলাকা মতিঝিলে ফুটপাত দখলে রাখার জন্য চাঁদার হার অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি। কারণ এখানে বিক্রি বেশি। চাঁদা না দিলে পুলিশ ফুটপাতের দখল নিতে দেয় না বলে জানান হকাররা।
এদিকে, পুরান ঢাকার সবগুলো রাস্তা দখলে করে চুটিয়ে ব্যবসা করছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি মার্কেটের সামনে দোকানের মালামাল। হাঁটার মতো কোনো জায়গা খালি নেই। গুলিস্তান পার্কের দক্ষিণ পাশের সড়কে ফুটপাত বলে কিছু নেই। সড়কের একপাশ ভাঙাচোরা, সেখানে বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টার করা হয়েছে।
সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের কাছে নতুন ফুটপাত করেছে ডিএসসিসি। প্রশস্ত এ ফুটপাতের একটি অংশে আবার যাত্রী ছাউনি করা হয়েছে। ছাউনির একপাশে একটি টিকেট কাউন্টার ফুটপাতের পুরোটাই খেয়ে ফেলেছে।
একই চিত্র ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনেও। মহাখালী রেলক্রসিং থেকে আমতলী হয়ে কাকলী পর্যন্ত গেলে দেখা যায় ফুটপাতের বিভিন্ন অংশে থাই অ্যালুমিনিয়ামের দোকানের জিনিসপত্র রেখে কাজ করা হচ্ছে। কয়েকটি মেরামত কারখানার মোটরসাইকেলও রাখা হয় ফুটপাতে।
ফুটপাথ মূলত পথচারীদের জন্য। ফুটপাথে কোনধরণের দোকানপাট থাকতে পারে না। সিটি কর্পোরেশনকে ফুটপাথে জেঁকে বসা হকারদের অন্যত্র ব্যবসা বাণিজ্য চালানোর বন্দোবস্ত করে দিয়ে ফুটপাথে নির্ভেজাল সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি শুধু নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির সাথে জড়িত নয়, বরং যানজট সমস্যা নিরসনেও গুরুত্বপূর্ণ।