ফেনী শহরের অলিগলিতে, উপজেলার গ্রামাঞ্চলে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। হত্যা, চুরি, ছিনতাই, স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, যৌন হয়রানিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে উঠতি বয়সী এসব কিশোররা।
এদের অনেকের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। ‘বড় ভাইয়েরা’এলাকায় প্রভাব বিস্তার, বিপক্ষের নেতা-কর্মীকে ধমকানো-শাসানো, জমিজমা বাগিয়ে নেওয়াসহ নানা স্বার্থ উদ্ধারে কিশোর গ্যাং লালন করা হয় বলে জানা গেছে। ফলে পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে চেষ্টা করেও তাদের ফেরানো যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফেনী জেলায় অন্তত ১০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। ‘বড় ভাইদের’ আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা এখন বেপরোয়া, ভয়ংকর। এদের রাজত্ব জেলা শহর থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত। বড় বড় হাটবাজার ঘিরেও এদের প্রভাব। মাদকের জগতেও রয়েছে বিচরণ। সংঘবদ্ধ হয়ে ছিনতাই, নারী উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, হানাহানি থেকে শুরু করে খুনোখুনিতেও জড়িয়ে পড়েছে এরা।
কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতাদের পাল্লা ভারী করতেই মূলত কিশোর গ্যাং সদস্যদের ডাকা হয়। ফেনীতে ‘কসাই’, ‘হিমিল’, ‘শান্ত’, ‘জেকে’, ‘পিটু’, ‘চাকমা জাবেদ’সহ একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতার কথা শোনা যায়। উঠতি বয়সী তরুনদের এ ভয়ংকর রূপ ভাবিয়ে তুলেছে অভিভাবক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের।
বৃহস্পতিবার ফেনী পৌরসভার মধ্যম রামপুর এলাকা থেকে এসডিকে গ্রুপের প্রধান মো. রাব্বি, মো. তৌহিদুল ওরফে সাগর, মো. ফখরুলকে আটক করা হয়। ফেনী জেলার বিভিন্ন এলাকায় সংঘবদ্ধ হয়ে মারামারি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও ইভটিজিংসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত ছিলেন তারা।
তারা প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে স্থানীয় এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নিজেদের মধ্যে মারামারি, অন্য সাধারণ কিশোরদের মারধর ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া, দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন এবং মাদক সেবন করে বলে জানা গেছে। আটকের সংখ্যা বেশি হলেও কয়েকজন পরীক্ষার্থী হওয়ায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসডিকে গ্রুপের এক সদস্য জানান, ‘নেতাদের কোনো প্রয়োজন হলে তারা বড় ভাইদের বলেন। আর বড় ভাইরা আমাদের নিয়ে অপারেশন কমপ্লিট করেন। এক্ষেত্রে সদস্যরা কিছু টাকা পায়।’
কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আটক করা হলে তাদের ছাড়ানোর জন্য বড়ভাই বা নেতাদের কল আসে বলে জানান এক পুলিশ কর্মকর্তা।
ফেনী গার্লস স্কুল এবং মহিলা কলেজের সামনে ছাত্রীকে একদল বখাটে উত্ত্যক্ত করে। অপরদিকে, ফেনীর জিয়া মহিলা কলেজ, ফেনী সরকারি কলেজ, মহিপাল সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের প্রতিনিয়তই কিছু বখাটে কিশোর দাঁড়িয়ে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করে। এসব কিশোর গ্যাং ধরতে ইতোমধ্যে ফেনী জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
সম্প্রতি ফেনীতে ঘটে যাওয়া বখাটেদের কয়েকটি ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচগাছিয়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতা কর্তৃক ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা; ফালাহিয়ায় সহিংসতা।
এদিকে, কিশোর গ্যাংয়ের আঘাতে কিছুদিন আগে জায়লস্কর ইউনিয়নের নুরুল্লাপুর গ্রামে সজীব নামে এক ছেলে মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া শহরতলির আল জামিয়াতুল কামিল মাদরাসায় একদল বখাটে কিশোর তাণ্ডব চালায়। এ সময় পুলিশ খবর পেয়ে মাদরাসায় অভিযান পরিচালনা করলে তারা পালিয়ে যায়।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হায়দার ক্লিনিকের পাশে খালি জায়গায় কিশোর গ্যাং ‘এফসিবি’ মারামারির একটি দৃশ্য ভাইরাল হয়। ভিডিও ফুটেজে ফেনী মডেল হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র আমিরুল হুদা মুবিনকে পিটিয়ে আহত ও পা ধরে ক্ষমা চাওয়ানোর দৃশ্য দেখা যায়। রাতে নির্যাতনের শিকার কিশোরের মা পারভিন আক্তার বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় ১১ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৩ কিশোরকে গ্রেপ্তার করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফেনীর এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ফেনী শহরের স্কুলগুলোতে ও পাড়াকেন্দ্রিক সক্রিয় রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক গ্রুপ। এরা শহরের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী। এক গ্রুপের সদস্যকে মারধরের ঘটনা ঘটলে প্রতিশোধ নিতে কালক্ষেপণ করে না অন্য গ্রুপের সদস্যরা। এদের স্কুলব্যাগে চাপাতি, পকেটে থাকে ক্ষুর। আধিপত্য বিস্তার, ছোট ভাই-বড় ভাই ও প্রেম-সংক্রান্ত বিষয়সহ ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি হলেই মারামারিতে লিপ্ত হয়। এরা স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করে।’
ফেনী পুলিশ কোয়ার্টার এলাকার বাসিন্দা ওয়াজি উল্লাহ জানান, ‘প্রকাশ্যে চলে সিগারেট, মদ-গাঁজা সেবনসহ নানান অপকর্ম। তাদের দৌরাত্ম্যে বন্ধ থাকে মার্কেটের বেশিরভাগ দোকান। ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না দোকান মালিকরা। কিশোর গ্যাংয়ের কারণে দোকান মালিকরা অতিষ্ঠ। দিন দিন কাস্টমার কমে যাচ্ছে। সকাল-বিকাল প্রতিদিন মারামারি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিকাল থেকে রাতের ১০টা পর্যন্ত তাদের আসর জমে।’
ফেনী জেলা পুলিশ সুপার জাকির হাসান বলেন, ‘শিশু ও কিশোর অপরাধ এবং কিশোর গ্যাং দমনে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে সমাজকে আরও সচেতন হতে হবে। অভিভাবকদেরও শিশু-কিশোরদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সবসময় কাজ করছে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ শেষে সন্ধ্যার পর শিক্ষার্থীদের রাস্তাঘাটে আড্ডা না দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।’
—–ইউএনবি
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি