জেলা প্রতিনিধি, ফেনী :
৮ বছর পার হল ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হক একরাম হত্যাকান্ডের। দীর্ঘ সময় পার হলেও বহুল আলোচিত এ মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামিকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। অধিকাংশ আসামি দেশের বাইরে বলে দাবি রাষ্ট্রপক্ষের। পরিবারের ভাষ্য, অবিলম্বে আসামিদের দেশে ফেরত এনে বিচারের রায় কার্যকর করা হোক। নয় তো আদালতের রায়ের মধ্যেই বিচার থমকে থাকবে।রায় কার্যকর না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে একরামের পরিবার ও গ্রামবাসী। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
এদিকে চাঞ্চল্যকর এই মামলায় ২০১৮ সালের বিচারিক আদালত রায় দিলেও এর বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্স (আপিল অনুমতির আবেদন) ও জেল আপিলের শুনানি হাইকোর্টে এখনও শুরু হয়নি। মামলার পেপারবুক তৈরি হয়েছে। প্রধান বিচারপতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই মামলাটি শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করে দিলে শিগগির এর শুনানি শুরু হতে পারে।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, মামলার পেপারবুক তৈরি হয়ে আছে। আদালতের ক্রমানুসারে কার্যতালিকায় মামলাটি শুনানির জন্য আসবে। যেসকল আসামি পলাতক রয়েছেন তাঁদের পক্ষে নিয়ম অনুযায়ী আদালত আইনজীবী (রাষ্ট্রনিযুক্ত) নিয়োগ দেবেন। অর্থাৎ পলাতকদের জন্য বিচার প্রক্রিয়া ঝুলে থাকবে না।
পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের উদ্যোগ না থাকা এবং হাইকোর্টে মামলাটি ঝুলে থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী নিহতের বড় ভাই রেজাউল হক জসিম। তিনি বলেন, বিচারিক আদালতে রায় হওয়ার পর ৪ বছর পেরিয়েছে। এখনও ১৬ জন আসামি পলাতক। রায় কার্যকর হচ্ছে না। আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে খুনিদের বিদেশ থেকে দেশে এনে এই রায় কার্যকর করা সম্ভব।
২০১৪ সালের ২০ মে ফেনী শহরের একাডেমী রোড়ে বিলাসী সিনেমা হলের সামনে ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি একরামকে গুলি করে, কুপিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় নিহতের বড় ভাই রেজাউল হক জসিম হত্যা মামলা করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ এ মামলায় রায় দেন ফেনীর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আমিনুল হক। রায়ে ৩৯ আসামিকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। তবে মামলার প্রধান আসামি বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী মিনারসহ ১৬ জনকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ২৩ জন বর্তমানে কারাগারে আছেন। আটজন জামিনে মুক্ত হয়ে পলাতক এবং আটজন শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন। পলাতক আসামিরা হলেন- জাহিদ হোসেন জিহাদ, আবিদুল ইসলাম আবিদ, নাফিজ উদ্দিন অনিক, আরমান হোসেন কাউসার, জাহেদুল হাসেম সৈকত, জসিম উদ্দিন নয়ন, এমরান হোসেন রাসেল ওরফে ইঞ্জি. রাসেল, এরফান ওরফে আজাদ, একরাম হোসেন ওরফে আকরাম, শফিকুর রহমান ওরফে ময়না, কফিল উদ্দিন মাহমুদ আবির, মোসলে উদ্দিন আসিফ, ইসমাইল হোসেন ছুট্টু, মহিউদ্দিন আনিস, বাবলু ও টিটু।
হত্যার ১০০ দিন পর ওই বছরের ২৮ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ ৫৬ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আদালত ১২ নভেম্বর আলোচিত এ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। অভিযোগপত্র দাখিলের ১৬ মাস পর ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ আদালত মামলার চার্জ করেন আদালত। এরপর শুরু হয় বিচারকাজ।
আদালত মামলার বাদী, একরামের ছোট ভাই এহসানুল হক, নিহতের স্ত্রী তাসমিন আক্তার, গাড়িচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ ৫০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেন। মামলায় ৫৯ জনকে সাক্ষী করে পুলিশ। এর মধ্যে সাধারণ সাক্ষী ছিল ২৮ জন। গ্রেফতারদের মধ্যে ১৬ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একাধিক চাপাতি ও ৫টি পিস্তলের মধ্যে কয়েকটি চাপাতি এবং দুটি পিস্তল উদ্ধার করে পুলিশ।
২০১৮ সালের ১৩ মার্চ ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আমিনুল হক এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ৩৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬ জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
এ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি ২৩ জন হলেন- হত্যার পরিকল্পনাকারী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির আদেল, ফেনী পৌরসভার কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহিল মাহমুদ শিবলু, সাজ্জাদুল ইসলাম পাটোয়ারী ওরফে সিফাত, আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে বন্ধর, মো. আজমির হোসেন রায়হান, মো. শাহজালাল উদ্দিন শিপন, জাহিদুল ইসলাম জাহিদ ওরফে আজাদ, কাজী শানান মাহমুদ, মীর হোসেন আরিফ ওরফে নাতি আরিফ, আরিফ ওরফে পায় আরিফ, রাশেদুল ইসলাম রাজু, মো. সোহান চৌধুরী, জসিম উদ্দিন নয়ন, নিজাম উদ্দিন আবু, আবদুল কাইউম, নুর উদ্দিন মিয়া, তোতা মানিক, মো. সজিব, মামুন, রুবেল, হুমায়ূন ও টিপু।
খালাসপ্রাপ্ত ১৬ জন হলো প্রধান আসামি জেলা তাঁতী দলের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী মিনার, একরামের একান্ত সহযোগী আওয়ামী লীগ নেতা বেলাল হোসেন পাটোয়ারী ওরফে টুপি বেলাল, পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়াউল আলম মিস্টার, মো. আলমগীর ওরফে আলাউদ্দিন, আবদুর রহমান রউফ, সাইদুল করিম পবন ওরফে পাপন, জাহিদ হোসেন ভূঁইয়া, ইকবাল হোসেন, মো. শাখাওয়াত হোসেন, শরিফুল ইসলাম পিয়াস, কালা ওরফে কালা মিয়া, নুরুল আবসার রিপন, মো. ইউনুস ভূঁইয়া শামীম ওরফে টপ শামীম, মো. মাসুদ, কাদের ও ফারুক।
পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে ফেনী সদর মডেল থানার ওসি মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তবে যতটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যায়, পলাতক আসামিদের অনেকে বিদেশে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে আমরা গত ১৩ নভেম্বর মামলার অন্যতম আসামি জিয়াউর রহমান বাপ্পীকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি ফেনীর বালিগাঁওয়ের সুন্দরপুর থেকে গ্রেপ্তার করেছি। তাই বলা যায়, আসামিরা বিদেশে অবস্থান করছে- এমন তথ্য তাঁদের পরিবার থেকে ছড়ানো হলেও তার সত্যতা নেই। ছদ্মবেশে অনেকেই দেশে আছেন। আমরা তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।
এদিকে বিচারিক আদালতের রায়ে খালাস পাওয়া আসামিদের সাজা নিশ্চিতে হাইকোর্টে আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। যার শুনানিও ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিল শুনানির সময় গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে আসামিপক্ষে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, প্রধান বিচারপতি কোনো নির্দিষ্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য মামলাটি পাঠালে সেখানে শুনানি হতে পারে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি