April 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, January 19th, 2023, 7:48 pm

ফেরত মিলছে না ই-কমার্স কোম্পানির প্রতারণার শিকার লাখো গ্রাহকের টাকা

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

ফেরত মিলছে না ই-কমার্স কোম্পানির প্রতারণার শিকার লাখো গ্রাহকের বিপুল পরিমাণ টাকা। ১৩টি কোম্পানির কাছ থেকে গ্রাহকরা আংশিক টাকা ফেরত পেলেও ১৪টি কোম্পানি কোনো টাকাই দেয়নি। গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়ার সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের মতে, গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তবে প্রতারিত গ্রাহকের তথ্য পাওয়া কঠিন। কোম্পানিগুলো এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে না। প্রতারণার বিপুল অঙ্কের টাকা ফেরত পাওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত। ইতোমধ্যে অভিযোগ ওঠা কোম্পানির কেউ কেউ দেশ ছেড়েছে, আবার কেউ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছে। আবার কয়েকটি কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ ওসব কম্পানির টাকার দায় নিচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ই-কমার্স খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ই-কমার্স খাতের বন্ধ প্রতিষ্ঠানের কাছে মার্চেন্ট ও ভোক্তাদের অর্থ রয়েছে। ওই অর্থ দেয়ার জন্য সরকার চেষ্টা করছে। তার মধ্যে যাদের ব্যবসা চালু হবে তারা ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নজরদারিতে থেকে গ্রাহকের অর্থ পরিশোধ করবে। আর যাদের ব্যবসা আইনভঙ্গ করার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের বিষয়ে প্রচলিত আইনে সরকার বা আদালত আলাদা সিদ্ধান্ত দেবেন। যাদের অর্থ পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে আছে তাদের ক্ষেত্রে তালিকা ও অভিযোগ যাচাই করে টাকা পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করছে।
সূত্র জানায়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি গ্রাহকদের কাছ থেকে এক হাজার কোটি টাকা নিয়েছে, ই-অরেঞ্জের গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের পাওনা এক হাজার ১০০ কোটি টাকা, ধামাকা নিয়েছে ৮০৩ কোটি টাকা, এসপিসি ওয়ার্ল্ড ১৫০ কোটি টাকা, এহসান গ্রুপ ১১০ কোটি টাকা, নিরাপদডটকম ৮ কোটি টাকা, চলন্তিকা ৩১ কোটি টাকা, সুপম প্রডাক্ট ৫০ কোটি টাকা, নিউ নাভানা ৩০ কোটি টাকা, কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং ১৫ কোটি টাকা, সিরাজগঞ্জশপ ৪৭ কোটি ও আলাদিনের প্রদীপ নিয়েছে ১০০ কোটি টাকা। তাছাড়া অভিযোগ ওঠা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন কম্পানি ও মার্চেন্টের কাছ থেকে বাকিতে নেয়া পণ্যের অর্থও ফেরত দেয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ওই টাকার কোনো হিসাব দিতে পারছে না। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিউকমে আটকে থাকা টাকা দিয়ে টাকা ফেরত দেয়ার উদ্যোগ নেয়। ২০২১ সালের ৩০ জুন এসক্রো পদ্ধতি চালুর পর থেকে কিউকমের গ্রাহকদের আটকে থাকা ৫৯ কোটি টাকা ফেরতের তালিকা গত বছরের জানুয়ারিতে করা হয়। কিউকমের পর আলেশা মার্ট, দালাল প্লাস, বাংলাদেশ ডিল, আনন্দের বাজার, শ্রেষ্ঠ ডটকম, আলিফ ওয়ার্ল্ড, ধামাকাসহ ১১টি প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের আংশিক টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। ২৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১১০টি মামলা রয়েছে। আর সিআইডি মোট ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে।
সূত্র আরো জানায়, প্রতারণার অভিযোগ ওঠা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোয় ক্রয়াদেশ দেয়ার পর প্রায় ৫২৫ কোটি টাকা বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে রয়েছে। তার মধ্য থেকে ৩২৪ কোটি টাকা গ্রাহক ফেরত পেয়েছে। বাকি ২০১ কোটি টাকা গ্রাহকরা এখনো ফেরত পায়নি। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফেরত দিয়েছে ফস্টার পেমেন্ট। ওই হিসাব ২০২১ সালের ৩০ জুনের পরবর্তী সময়ের। কিন্তু ২০২১ সালের ৩০ জুনের আগের সময়ে প্রতারিত কোনো গ্রাহকের দায়িত্ব সরকার নিতে চাইছে না। আর ৫২৫ কোটি টাকার মধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কোনো টাকাই ফেরত দেয়নি। ১৩টি ফেরত দিয়েছে আংশিক টাকা। ফেরত না দেওৎয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ইভ্যালি, সিরাজগঞ্জ শপ, নিডস, টোয়েন্টিফোর টিকেটি, ই-অরেঞ্জ, উইকুম, আকাশ নীল, প্রিয় শপ, আলাদীনের প্রদীপ, আমার বাজার, আস্থার প্রতীক, বাড়ির দোকান ডটকম, নিরাপদ ও ইনফিনিটি মার্কেটিং লিমিটেড। বর্তমানে সব মিলিয়ে দেশে প্রায় আড়াই হাজার ই-কমার্স সাইট আছে। আর দেড় লাখেরও বেশি ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগ রয়েছে। অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে পরিচালনা করছে। তাছাড়া এক হাজার প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম পাওয়া গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়ার সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছে। বিশ্বে ই-কমার্স ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখলেও বাংলাদেশে যথাযথ উদ্যোগ ও যুগোপযোগী আইনের অভাব, সাধারণ গ্রাহকদের মাঝে বিভ্রান্তি ও কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার জন্য ই-কমার্স খাত আশানুরূপ বিকশিত হয়নি। বর্তমানে ই-কমার্স খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৪০ শতাংশ। ২০২২ সালে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো লেনদেন হয়েছে। করোনার আগে খাতটিতে ৩০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল।
এদিকে বিশেষজ্ঞ এবং ই-কমার্স খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদ্যমান আইন সংশোধনের মাধ্যমে যথাযথ প্রয়োগ করে প্রতারণামূলক ই-কমার্স ব্যবসাগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি আইন প্রয়োগের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাছাড়া দক্ষ জনবল বৃদ্ধি এবং নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। কিছু কম্পানির ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায়িক মডেলে গ্রাহকদের আস্থা নষ্ট হওয়ায় খাতটিতে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বেশির ভাগ কোম্পানির সম্পদের তুলনায় দায় এত বেশি যে টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ কম। ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত ১৬টি কম্পানির সদস্য পদ স্থগিত করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ২৪টি কম্পানি নিয়ে তদন্ত করছে। তবে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া গেলে খাতটিতে আস্থা ফিরে আসবে।
অন্যদিকে এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান জানান, টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। কমার্স সেল ৩০০ কোটি টাকার বেশি ফেরত দিয়েছে। বাকি টাকা ফেরত দেয়ার কাজ চলছে। প্রতারিত গ্রাহকের তথ্য পাওয়া কঠিন হচ্ছে। কোম্পানিগুলোও তথ্য দিতে পারছে না। পেমেন্ট গেটওয়েতে থাকা টাকা পাওনার পরিমাণ ৫০০ কোটির বেশি। গেটওয়ের বাইরে কত টাকা তার তথ্য পাওয়া মুশকিল। ইভ্যালি নির্দিষ্ট তিনটি তারিখে টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলেছে। কিন্তু তারা তালিকা দিতে পারছে না। নতুন করে কোনো কোম্পানির ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়নি। নতুন করে আর প্রতারণা করার সুযোগ নেই। আর কেউ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।