জেলা প্রতিনিধি, শেরপুর (ঝিনাইগাতী):
শেরপুর সীমান্তের ভারত থেকে নেমে আসা কালাঘোঁষা নদীতে স্লুইচগেট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে এলজিইডি বিভাগ। জাইকার অর্থায়নে বনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদীতে স্লুইচগেট নির্মাণ হলে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়বে শাল গজারির এই বন, চিরতরে সৌন্দর্য হারাবে গারো পাহাড়। ইতোমধ্যে এই প্রকল্প বন্ধ করতে এলজিইডিকে চিঠি দিয়েছে বনবিভাগ, আর জনজীবন রক্ষায় বিক্ষোভ ও মানব বন্ধন করেছে সীমান্তের আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন।
বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া কালাঘোঁষা নদীর দুই তীরে রয়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী। পুরো এলাকা জুড়ে রয়েছে শাল গজারীর বিশাল বনভূমি। এছাড়া রয়েছে বনবিভাগের সামাজিক বনায়ন ও সুফল বাগান প্রকল্প। বন বিভাগের বৃহৎ অংশের পাশাপাশি এখানে রয়েছে মালিকানাধীন রেকর্ড সম্পদও। যেখানে বেশিরভাগই আবাদী জমি। বন্যহাতির আক্রমণ থেকে ফসল বাঁচাতে নিজেদের তাগিদেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে স্থানীয় জনগণ।
নদীতে গ্রামের এই অংশে কোন ব্রিজ না থাকায় পায়ে হেঁটেই নদী পাড় হতে হয় হালচাটি গ্রামের কোচ পাড়ার আদিবাসীদের। বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে মাত্র একটি প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যেতে হয় হাঁটু পানি পেরিয়ে। বর্ষায় পানি বেড়ে গেলে দুর্ভোগ বাড়ে স্থানীয়দের। এলজিইডির তথ্যমতে, এখানকার কাঁচা সড়কটি গেজেটভুক্ত না হওয়ায় ব্রিজ নির্মাণ সম্ভব নয়। ফলে নদীতে পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করতে হয় এলাকাবাসীর।
সম্প্রতি এই নদীর ভাটি এলাকায় গান্ধিগাঁও অংশে জাইকার অর্থায়নে স্লুইচগেট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে এলজিইডি বিভাগ। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে এখন শুধু প্রকল্প শুরুর অপেক্ষা। কিন্তু এই স্লুইচগেট নির্মাণ হলে উজানের হালচাটি অংশে সারাবছর পানি জমে থাকলে যাতায়াত বন্ধসহ দূর্ভোগে পড়বে স্থানীয়রা। গান্ধিগাঁও অংশের যে স্থানে স্লুইচগেট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার পার্শ্ববর্তী প্রায় সকল জমিই বন বিভাগের। দীর্ঘদিন ধরে আবাদের অজুহাতে জমি ছাড়ছে না দখলদাররা। তাদের উচ্ছেদে বনবিভাগের বিভিন্ন সময়ে নানা কার্যক্রম থাকলেও সেই জমিগুলোতে চাষের জন্য পানি সরবরাহের অযুহাতে এই স্লুইচগেট দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হবে বনবিভাগের।
এছাড়া স্লুইচ গেট নির্মাণ হলে ক্ষতির মুখে পড়বে বনভূমি, মারা যাবে প্রায় হাজার একর জমির শাল গজারি গাছ। আটকে রাখা গভীর জলে যাতায়াত বন্ধ হবে দুই পাড়ের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের। ক্ষতিগ্রস্থ্য হবে উজানের আবাদি জমির। সম্প্রতি এই প্রকল্প বন্ধের দাবীতে বিক্ষোভ ও মানব বন্ধন করেছে সীমান্তের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ।
স্থানীয় কৃষক রশিদ মিয়া বলেন, নদীর দুই ধারেই বনাঞ্চল। স্লুইচগেট বসালে পানি আটকে থাকলে বন এমনিই মারা যাবে। তখন আর বন টিকায়া রাখা যাবে না। কোচপাড়ার হরিনাথ কোচ বলেন, আমাদের কোন ব্রিজ নাই। এই পানি পার হয়ে আমাদের এলাকায় যেতে হয়। বন্যহাতি আসলে এই পাড়ের মানুষ আমাদের সাহায্য করে আবার এই পাড়ে হাতি নামলে আমরা তাদের সাহায্য করি। এখানে স্লুইচগেট হইলে দুইপাড়ের মানুষই বিপদে পড়বে। স্কুল শিক্ষার্থী ঝুমুর বলেন, আমাদের এই নদী পাড় হয়েই স্কুলে যেতে হয়। স্লুইচগেট থাকলে পানি বেশি থাকবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারবে না। আমাদেরও অনেক সমস্যা হবে।
পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক মেরাজ উদ্দিন বলেন, এই গারো পাহাড় শেরপুর পর্যটন শিল্পের ঐতিহ্য। গুটিকয়েক কৃষকের আবাদের সুবিধার জন্য এই স্লুইচগেট নির্মাণ হলে পুরো বনটাই ধ্বংসের মুখে পড়ে যাবে। আমরা এই প্রকল্পের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। সবুজ বন নষ্ট করে এখানে কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না। প্রয়োজনে সবুজ আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত।
এদিকে বন রক্ষায় স্লুইচগেট না করতে ইতোমধ্যে এলজিইডিকে চিঠি দিয়েছে বন বিভাগ। আপত্তির প্রেক্ষিতে আবারো আবেদন করে পরবর্তী কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে এলজিইডি। শেরপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। আমাদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে, এই স্লুইচগেট হলে স্থানীয়দের আবাদের সুবিধা হবে। তবে কিছু অসুবিধার কথাও আমরা জানতে পেরেছি। বন বিভাগ থেকে আমাদের একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। আমরা তাদের আপত্তির বিষয়েও কাজ করছি। সবশেষ তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সকল পর্যবেক্ষণ শেষ হলেই আমরা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবো।
এদিকে বনভূমি ও জীব বৈচিত্রের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া কাজ করতে দিবে না বনবিভাগ। ময়মনসিংহ বন বিভাগ সহকারী বন সংরক্ষক আবু ইউসুফ বলেন, বনের ভেতর বয়ে যাওয়া নদীতে বাঁধ সৃষ্টি করে স্লুইচগেট নির্মাণ হলে বনের ভয়াবহ ক্ষতি হবে। বনের ভেতর কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে অবশ্যই মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। সেই অনুমতি ছাড়া আমরা কোনভাবেই কাজ করতে দিবো না। এখানে এই স্লুইচগেট নির্মাণ হলে বনের গাছের পাশাপাশি জীব বৈচিত্রও ভয়াবহ হুমকির মধ্যে পড়বে।
বনের পরিবেশ রক্ষায় ও গারো পাহাড় সংরক্ষণে নদীতে স্লুইচ গেট নির্মাণ বন্ধের দাবী বনবিভাগ ও স্থানীয়দের। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে আরো অধিক পর্যবেক্ষণ করার কথা বলছেন পরিবেশবিদরা।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি