নিজস্ব প্রতিবেদক:
কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না বিদ্যুৎ চুরি। অথচ লোকসান ঠেকাতে সরকার বার বার বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। আর বিদ্যুতের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। কিন্তু সিস্টেম লসের নামে বিদ্যুৎ খাতের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দিনের পর দিন প্রকাশ্যে চুরির চালিয়ে যাচ্ছে। আর চুরির বিদ্যুৎকে সিস্টেম লস হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি চুরির কারণে যে লোকসান হয় তা পুষিয়ে নিতে গ্রাহকপর্যায়ে ভুতুড়ে বিল চরম হয়রানি করা হয়। রাজধানীতে পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা গঠিত হলেও সিস্টেম লসের নামে বিদ্যুৎ চুরি বন্ধ হচ্ছে না। বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) থেকে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় প্রথমে গঠিত হয় ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই অথরিটি (ডেসা)। অনিয়মের মুখে পড়ে ডেসা বিলুপ্ত করে। গঠন করা হয় ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) এবং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। কিন্তু দুটি বিতরণ কোম্পানি গ্রাহকরা আশানুরূপ সেবা পাচ্ছে না। বরং পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। নতুন সংযোগ পেতে অসাধু কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সময় সরকারের তরফ থেকে সিস্টেম লস কম দেখানো হলেও তা আসলে বিদ্যুৎ চুরি কমেনি, উল্টো সিস্টেম লসের নামে গোঁজামিল দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সূত্র জানায়, সিস্টেম লসের কারণে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। বিগত ২০১০-১১ সালে বিদ্যুৎ খাতে সামগ্রিকভাবে বছরে গড় সিস্টেম লস ছিল ১৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা কমে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে। তার মধ্যে সঞ্চালন লাইনে ক্ষতি হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। যা আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে। রাজধানীতে অবৈধভাবে তৈরি কাঁচা তরকারি, মাছ ও ফলের দোকান, লেপ-তোশকের দোকান, ভাঙারি দোকান, মোটর গ্যারেজ, খাবার হোটেলসহ ফুটপাতে লাইট, ফ্যান ও বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম চালাতে বিদ্যুৎ অফিসের লোকজনই সংযোগের ব্যবস্থা করে দেয়। সিস্টেম লস কমাতে ঢাকার বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার জন্য ১৯৯১ সালে ডেসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর ২০০৮ সালে ডেসা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ডেসার চরম দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ১৯৯৮ সালে ডেসার একটি অংশ বনানী, গুলশান, মিরপুর ও উত্তরা নিয়ে ডেসকো নামে নতুন কোম্পানি গঠিত হয়। আর ডেসার বিশাল টাকার দায় অমীমাংসিত রেখেই ২০০৮ সালে গঠিত হয় ডিপিডিসি। বর্তমানে ঢাকায় ডেসকো ও ডিপিডিসি এ দুটি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ বিতরণ কাজে নিয়োজিত। তার পরও সিস্টেম লস কমানো যাচ্ছে না, বরং ওই দুই প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতি বেড়েছে। সব মিলিয়ে সেবা খাত দুটির বিশৃঙ্খলা নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রায় ১৬৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ফুটপাত রয়েছে। এসব ফুটপাতের সাড়ে ৩ লাখ দোকানে প্রায় ৫ লাখ অবৈধ বৈদ্যুতিক বাতি জ¦লে। বাতিপ্রতি গড়ে ৩০ টাকা হিসেবে দিনে ব্যয় হয় দেড় কোটি টাকা। ওই হিসেবে মাসে ৪৫ কোটি আর বছর শেষে অঙ্ক দাঁড়ায় ৫৪০ কোটি টাকা। রাজধানীর ফুটপাত ও রাস্তার ওই টাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির অসাধু কর্মচারীদের পকেটে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে এর হিসাব নেই। এ বিষয়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো তথ্যও নেই। ডিপিডিসির দৈনিক প্রায় ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চুরি হয়। ডিপিডিসির সিস্টেম লস ৭ শতাংশ আর ডেসকোর ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। বিদ্যুতে ১ শতাংশ সিস্টেম লস হলে ক্ষতি হয় ৭০০ কোটি টাকা। আর এ সিস্টেম লসের হার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য বিবেচনার চেয়ে বেশি। ডিপিডিসি ও ডেসকোর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদ্যুৎ চুরির বিষয়গুলো ওপেন সিক্রেট। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এলাকার চিহ্নিত দালাল চক্র দীর্ঘদিন ধরেই ইচ্ছামতো আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুতের লাইনে অবৈধ সংযোগ লাগিয়ে টাকা আয় করছে। সেজন্য দালালরা নিজেরাই মই বানিয়ে নিয়েছে। তারা তাদের ইচ্ছামতো যখন যেখানে লাইন দেয়া দরকার দিয়ে দিচ্ছে। অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে শত শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চুরি হলেও তা রোধে কর্তৃপক্ষ এখনো নিস্ক্রিয়। আর শুধুমাত্র ফুটপাতে অবৈধ সংযোগ দিয়ে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ চুরি করা হচ্ছে তার প্রায় দ্বিগুণ বিদৗিৎ ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা ও থ্রি-হুইলার চার্জ করতে গচ্চা যাচ্ছে। অথচ ওই বিদ্যুৎ বাবদ খুবই সামান্য রাজস্বই সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে। ব্যাটারি চার্জের জন্য সারা দেশে যেসব স্টেশন গড়ে উঠেছে, এর অধিকাংশের সংযোগই অবৈধ। এদিকে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি বিশেষজ্ঞরা মতে, সারা দেশে দৈনিক ১ ঘণ্টা লোডশেডিং করে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা হচ্ছে, সব চোরাই বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও অপচয় রোধ করা গেলে তার চেয়ে বেশি সাশ্রয় হবে। চাহিদা অনুযায়ী সাবস্টেশন নির্মাণ, ট্রান্সফরমার স্থাপনসহ বিতরণব্যবস্থা আধুনিকীকরণ, অবৈধ সংযোগ ও চুরি নিয়ন্ত্রণ, অনলাইনে মিটার রিডিং গ্রহণ, প্রি-পেইড মিটার স্থাপনসহ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে সিস্টেম লস কিছুটা কমলেও তা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেনি। এমন অবস্থায় সিস্টেম লস কমানোর দিকে নজর দেয়া জরুরি।
আরও পড়ুন
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
কমতে শুরু করেছে কুড়িগ্রামের নদীর পানি, ভাঙন আতঙ্কে মানুষ
দিনাজপুরে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় নিহত ২