জেলা প্রতিনিধি, সিলেট :
সিলেটে এবারের বন্যা যেন সব এলোমেলো করে দিয়েছে। বিশেষ করে সিলেটের মৎস্য খামারীদের স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছে স্মরণকালের এ ভয়াবহ বন্যা। এ অবস্থায় হাজারো মৎস্য খামারী এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন।
সরেজমিন জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, বালাগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে দেখা যায় শত শত পুকুর বন্যার পানিতে ভাসছে। কোন কোন পুকুরের চিহৃ দেখা যাচ্ছে। আর বেশীরভাগ পুকুর বিশাল জলারাশির নিচে ঢাকা। খামারীরা শেষ চেষ্টা হিসেবে জাল ও নেট দিয়ে মাছগুলো আগলের রাখার শেষ চেষ্টা করলেও পানির তোড়ের কাছে তারা হার মানেন।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সিলেট জেলার ১১টি উপজেলায় মোট ১৮ হাজার ৭৪৯টি পুকুর, দিঘী, হ্যাচারি ও মাছের খামার তলিয়ে গেছে। এতে ২ কোটি ১৩ লাখ মাছের পোনা এবং ২ হাজার ৩০৫ টন মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। মাছ ভেসে যাওয়া ছাড়াও হয়েছে অবকাঠামোগত ক্ষতি। এর ফলে সিলেট জেলার ১৫ হাজার ১৬৩ জন খামার মালিকের ২১ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জৈন্তাপুর এলাকার এক মাছ চাষি বলেন, পুকুরে মাছ চাষের জন্য ঋণ নিয়েছি। বন্যার শুরুতে পুকুরের চারদিকে ঘের দিয়ে মাছ বাঁচানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। বন্যার তোড়ে সব মাছ ভেসে গেছে।
একই উপজেলার আরেক মাছ চাষী বলেন, নির্ঘম রাত কাটিয়েও রক্ষা করতে পারিনি স্বপ্নের খামারটি। চোখের সামনেই ভেসে গেছে মাছ।
বন্যায় জকিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, বিশ্বনাথ, জৈন্তাপুর ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় মাছের খামারের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি।
জকিগঞ্জে ৬ হাজার ৩৫০টি মাছের খামার তলিয়ে ৬ কোটি ২২ লাখ টাকা, গোয়াইনঘাটে ২ হাজার ৫৯২টি খামার তলিয়ে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা, কানাইঘাটে ২ হাজার ৩৫০টি খামার তলিয়ে ৬৪ লাখ টাকা, বিশ্বনাথে ২ হাজার ১৫০টি খামার তলিয়ে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, জৈন্তাপুরে ২ হাজার ১০০টি খামার তলিয়ে ৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ও বিয়ানীবাজারে ১ হাজার ৪০২টি খামার তলিয়ে ২ কাটি ১৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া সিলেট সদর উপজেলায় ৫৩৫টি মাছের খামার, গোলাপগঞ্জে ৮৪৫টি, বালাগঞ্জে ৭০টি, কোম্পানীগঞ্জে ১৪৫টি ও দক্ষিণ সুরমায় ২১০টি খামার তলিয়ে গেছে।
জেলা মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, জেলায় মাছ চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা অপূরণীয়। আর এ ক্ষতির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
এদিকে, বন্যার পানিতে সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার, ছাতক, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও সুনামগঞ্জ সদর এলাকা মাছ চাষিদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবারের বন্যায় ১ হাজার ৩১০টি পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। এসব পুকুরে ১৬৮ মেট্রিক টন মাছ ও ৫০ মেট্রিক টন পোনা ছিল। জেলার ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় ক্ষতি হয়েছে বেশি। ছাতকে ৭৫০টি ও দোয়ারাবাজারে ৪৩৫টি পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত খামারির সংখ্যা ১ হাজার ১৪৭।
এদিকে, মাছ চাষীদের পাশাপাশি সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বন্যাকবলিত এলাকায় গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এতে কৃষক ও খামারিরা পড়েছেন বেকায়দায়।
একাধিক কৃষক ও খামারি জানিয়েছেন, ২০০৪ সালের পর সিলেটে বন্যার ব্যাপকতা এবারই বেশি ছিল। এ কারণে কৃষকের ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়েছে। এখনো নি¤œাঞ্চলে পানি রয়েছে। যে কারণে গোখাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকের কাছে খড় না থাকায় বিভিন্ন জায়গা থেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করে গরুকে খাওয়াচ্ছেন। অনেকে উচ্চমূল্যে অন্য জায়গা থেকে খড়ও কিনছেন।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, বন্যায় ২ হাজার ১২৮ দশমিক ১৫ একর চারণভূমি প্লাবিত হয়েছে। এখনো এর বেশির ভাগ পানিতে তলিয়ে আছে। বন্যায় জেলায় ১ হাজার ৭৩৪ মেট্রিক টন খড় বিনষ্ট হয়েছে।
জৈন্তাপুর উপজেলার এক কৃষক বলেন, পুরো উপজেলা জুড়ে গোখাদ্যের তীব্র সংকট চলছে। কৃষক ও খামারিরা গরুসহ গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। বন্যায় এখনো নি¤œাঞ্চল তলিয়ে থাকায় গোখাদ্য শিগগিরই সহজলভ্য হওয়ার সুযোগ তেমন নেই।
কৃষকেরা জানিয়েছেন, গ্রামে গ্রামে কৃষকেরা শুধু কচুরিপানা খাইয়ে গরু-ছাগল বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তাই বন্যার পানির সঙ্গে ভেসে আসা কচুরিপানা এখন সংগ্রহ করছেন কৃষকেরা। অনেক কৃষক নিজেদের গবাদিপশু বাঁচাতে ধারকর্জ করে টাকা এনে অন্য জায়গা থেকে খড় কিনে আনছেন। গোখাদ্যের সংকটে অনেকে গরু-ছাগল বিক্রিও করে দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি