অনলাইন ডেস্ক :
বিশ্বে সবকিছুতে নিজেদের সবার সেরা ভাবতে ভালোবাসে আমেরিকা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এক গভীর অসুখে ভুগছে দেশটি। সেই অসুখের নাম বর্ণবাদ। কাগজ-কলমে দেশটিতে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হয়েছে দেড়শো বছর আগে। কিন্তু সেই অসুখ তো কমেই নি। বরং সময়ের আবর্তনে তা দগদগ ক্ষতে রুপ নিয়েছে। যে দেশে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জীবনের চেয়ে অস্ত্র-বন্দুককে বেশি মূল্য দেওয়া হয় সে দেশটিকে অসুস্থই বলতে হবে বৈকি। মেক্সিকো সীমান্ত ও মেক্সিকো উপসাগর তীরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস রাজ্য। গত ২৪ মে রাজ্যের ছোট্ট শহর উভালডের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘটে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। সেদিন দুপুরে রোব ইলেমেন্টারি স্কুল নামে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গুলি চালিয়ে একে একে ১৯ শিক্ষার্থী ও দুই শিক্ষককে হত্যা করে এক বন্দুকধারী। যে স্থান শিশুদের কলকাকলিতে ভরপুর ছিল, মুহূর্তে তা গোরস্থানে পরিণত হয়। যে স্থান ছিল মসজিদ কিংবা মন্দিরের মতো তা কসাইখানায় রুপ নেয়। ভয়াবহ ওই ঘটনায় আরও একবার স্তম্ভিত হয়ে পড়ে মার্কিনিরা। আতঙ্কিত দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দিতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু বর্ণবাদের গভীর অসুখে পড়ে আমেরিকার চেহারা যেমন ফ্যাকাসে আর বিধ্বস্ত, সেদিন ওই ভাষণকালে বাইডেনকেও একই রকম ফ্যাকাসে আর বিধ্বস্তই লাগছিল। ‘জাতির উদ্দেশে ভাষণ’ বলা হলেও বাইডেন আদতে জাতিকে সম্বোধন করে কিছু বলেননি। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেদিন বাইডেন বড়জোর অতি পরিচিত কিছু শব্দ আর কিছুটা ক্ষোভের মিশেলে আমেরিকানদের সঙ্গে ফিসফিস করেছেন। সেদিন সম্ভবত কোনো গভীর বিষণ্ণতা তার ওপর ভর করেছিল। কিংবা বলা যায় পরাজয়। বাইডেনের গলার নিরানন্দ সর আর অসহায় ভঙ্গিতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, আগের সব প্রেসিডেন্টদের মতোই তিনিও সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছেন। অপার ক্ষমতা সত্ত্বেও এটা যেন তার সহজ স্বীকারোক্তি যে, আমেরিকার এ অসুখ এতটাই গভীর যে এর কোনো প্রতিকার বা চিকিৎসা তার কাছে নেই।উভালডের ওই ঘটনার পর অনেকটা শিকলের মতো একটার পর একটা বিদ্বেষপূর্ণ হামলা ঘটেই চলেছে। নিউটন, পার্কল্যান্ড, অরোরা, চার্লসটন, বোল্ডার ও রোজবার্গ- প্রতিদিনই যোগ হয়েছে নতুন নতুন শহরের নাম। যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে স্কুলে সশস্ত্র হামলার ঘটনাকে মহামারি বললেও অত্যুক্তি হবে না। দেশটির নেভাল পোস্টগ্রাজুয়েট স্কুলের সেন্টার ফর হোমল্যান্ড ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটির তথ্য মতে, চলতি বছর এ পর্যন্ত দেশটির স্কুলগুলোতে ১৩৭টি গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হামলাকারীরা বয়সে কিশোর বা তরুণ। আমেরিকার যে অসুখ তার লক্ষণ বিশ্বের অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে খুব কমই দেখা যায়। বিশ্বে এমন দেশ খুব কমই আছে যেখানে স্কুলে নির্দোষ শিশুদের এভাবে হত্যা করা হয়। কর্মক্ষেত্রে, শমিংমলে কিংবা চার্চে বন্দুক হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করা হয়। কারও গায়ের রং কালো নাকি সাদা সেই বিবেচনা থেকে এসব হত্যাকা- চালানো হয়। এটা সত্যিকার অর্থেই আমেরিকার গভীর অসুস্থতারই পরিচায়ক। যে দেশ স্কুলে কিংবা খেলার মাঠে কিংবা পথে-ঘাটে ছোট ছোট কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর ব্যবস্থা রাখে সে দেশ অসুস্থই বৈকি। এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর সরকার ও প্রশাসন এমন ভাব ধরে যেন কিছুই ঘটেনি এবং কোনো পদক্ষেপই না নেয় সে সরকার ও প্রশাসন অসুস্থই বৈকি। বর্ণবিদ্বেষের বহু ঘটনা অতীতে ঘটে গেছে। বর্তমানেও ঘটছে। আগামী দিনগুলোতেও ঘটতেই থাকবে। হঠাৎ করেই একই ধরনের ঘটনার কথা শোনা যাবে। স্যাটেলাইট টিভির পর্দায় দেখানো হবে সেই একই রক্তাক্ত দৃশ্য। পুলিশের সেই একই তৎপরতা। এরপর সেই একই হাহাকার। সেই একই ক্ষোভ। এরপর সেই একই ধরনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান। ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন উঠবে। জবাবও দেওয়া হবে একই। সেই একই রাজনীতিক সেই একই ধরনের অজুহাত দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করবে। বলবে, বন্দুক নিজে নিজে কোনো শিশুকে হত্যা করে না। খারাপ মানুষেরাই করে।উভালডে হত্যাকা-ের পর টেক্সাসকে ‘রেড’ রাজ্য অভিহিত করে টিভিতে হরদম টকশো হচ্ছে। চেচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে এক শ্রেণির রাজনীতিক। এদের বেশিরভাগই রিপাবলিকান গভর্নর, সিনেটর ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য। কিন্তু তারা সেই একই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী রিপাবলিকান যারা ভ্রুণ হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলে। কিন্তু ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর নবজাত শিশুর যে অধিকার সেটা তারা বেমালুম ভুলে যায়। তাদের দাবি, তারা মার্কিন সংবিধানের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। কিন্তু এটা যে সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা তা পুরো বিশ্বই জানে। তারা আসলে জনগণের শান্তি ও কল্যাণের বিরুদ্ধে কাজ করছে। সংবিধানের প্রতি তাদের কোনো আনুগত্য নেই। তাদের সব আনুগত্য এনআরএ’কে ঘিরে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যে বন্দুক ব্যবসা-তার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে এই সংগঠনটি। এনআরএ হচ্ছে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের সংক্ষিপ্ত রূপ। যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৬১ সাল ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বন্দুকের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। বাড়ে সৌখিন বন্দুকধারীর সংখ্যা। ১৮৭১ সালেএসব বন্দুকধারীদের নিয়ে একটি সংগঠন বা ক্লাব গড়ে ওঠে। এই ক্লাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। পরবর্তীতে এনআরএ বন্দুক ব্যবসায় জড়ি পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক নিয়ন্ত্রণে ১৯৩৪ সালে ন্যাশনালফায়ারআর্মস অ্যাক্ট (এনএফএ) পাস করা হয়। এরপর ১৯৬৮ সালে পাস হয় গান কন্ট্রোল অ্যাক্ট (জিসিএ)। প্রথম দিকে এই আইনের পক্ষেসমর্থন জানালেও বন্দুক ব্যবসা চালিয়ে যেতে রাজনীতিক তদবির শুরু করে এনআরএ। ১৯৭০-এর দশকে সংগঠনটি রাজনৈতিকভাবে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সরাসরি সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করতে তদবির চালিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯৭৫ সালে তারা ইনস্টিটিউট ফর লেজিসলেটিভ অ্যাকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। শুধু তাই নয়, রাজনীতিক ও আইনপ্রণেতাদের তহবিল যোগান দিতে ১৯৭৭ সালে পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি (পিএসি) নামে একটি তদবির গোষ্ঠী (লবি গ্রুপ) গড়ে তোলে এনআরএ। যুক্তরাষ্ট্রেকঠোর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের দাবিতে প্রায়ই বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়। ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিবিদরা নিয়মিত এর পক্ষে বক্তব্য দেন। কিন্তু রিপাবলিকানদের শক্ত বাধার মুখে অস্ত্র বিক্রির ওপর কড়াকড়ি আরোপের সব চেষ্টাই ভেস্তে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকদের আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা ও বহনের অধিকারেরপক্ষে সবচেয়ে বেশি ওকালতি করে যাচ্ছে পিএসি। এই তদবির গোষ্ঠীর মূলোৎপাটনে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসিতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মানবাধিকার আইনজীবীরা। তাদের অভিযোগ, সমিতির শীর্ষ নেতৃত্ব দাতব্য তহবিলের অপব্যবহার করেছে, তহবিলের অর্থ ব্যক্তিগত বিলাসবহুল জীবন যাপনে ব্যয় করেছে। অন্যদিকে এসব অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে এনআরএ। একের পর এক বন্দুক সহিংসতার পরও রিপাবলিকান রাজনীতিকরা এনআরএ’র আনুগত্য প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছেন। তারা একদিকে মানবাধিকার রক্ষার কথা বলছেন, অন্যদিকে বন্দুক নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এর মাধ্যমে তাদের চরম মুনাফেকিই প্রকাশ পাচ্ছে। আর এটাই আমেরিকার চরম অসুখ।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
গাজায় গত একদিনে নিহত ৫২