বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির টাকা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থতি বিপর্যস্ত করার জন্য ব্যবহৃত হওয়ার শঙ্কা !
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতিতে যে ‘মামা বাড়ির আবদার’ এ পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি দেশের কিছু জাতীয় দৈনিকের বিশেষ কিছু প্রতিবেদন ও আইএমইডির প্রতিবেদনে অনুযায়ী এমনটাই বলা যেতে পারে। তৎকালীন সময় দরপত্র আহবান করা হলেও স্থান বা পজিশন ছাড়াও বিভিন্ন অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে বাদ দিয়ে দেয়া হত স্বজন ব্যাতিত অন্যান্য কোম্পানির দরপত্র। বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় অংশই পেয়েছেন । এর মধ্যে সামিট, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার, ইউনাইটেড, এনার্জিপ্যাক অন্যতম।
বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর শেষ দুই মেয়াদে বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আবাসন ব্যবসায়ী নসরুল হামিদ বিপু। জানা গেছে সম্প্রতি আটক হওয়া নসরুল হামিদ নিজের পছন্দের লোকজনকে বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে নিয়োগ দিতেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়। এছাড়াও এসব অপকর্মের নেপথ্যে ছিল একটি মাফিয়া সিন্ডিকেট।
ওই সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য ছিলেন পিডিবির বর্তমান চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানসহ সাবেক দুই চেয়ারম্যান ও একাধিক প্রধান প্রকৌশলী, সাবেক অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন, প্রতিমন্ত্রীর ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু এবং সাবেক সেতুমন্ত্রীর এক ভাতিজা। আর সিন্ডিকেটের অবৈধ আয়ের হিসাবনিকাশের দায়িত্বে ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর এপিএস মুজাহিদুল ইসলাম মামুন, কেরানীগঞ্জের প্রভাবশালী শাহীন চেয়ারম্যান এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা মীর আসলাম। এছাড়ও সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের নামও উঠে এসেছে।
বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাস করা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বর্তমান চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই পিডিবির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে দুর্নীতি। চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বাগিয়ে নেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। তিনি এতটাই শক্তিশালী যে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরও আছেন বহাল তবিয়তে। বিগত সরকারের চুক্তিভিত্তিক সব কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও তিনি সর্বোচ্চ দাপট নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া থেকে শুরু করে অনুমোদন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০টি ধাপে ওই সিন্ডিকেটকে টাকা দিতে হতো। এর মধ্যে ছিল প্ল্যানিং, সাইট ভিজিট, মেশিনপত্র অনুমোদন দেওয়া, নেগোসিয়েশন, প্রকল্পের সাইট সিলেকশন, মাটি ভরাট, জমি ক্রয়, বিদ্যুৎ ক্রয়ের দরদাম ঠিক করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা বা কমিশনিং, মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পাঠানো, ক্রয় অনুমোদন, বিল অনুমোদন, বিল ছাড় করা-অর্থাৎ প্রতিটি খাতে এ সিন্ডকেটকে টাকা দিতে হতো।
নিউ নেশনের অনুসন্ধান অনুযায়ী, প্রথবারের মত দরপত্র আহবান করা হলেও, সন্দেহজনক দরপত্র আহবানের প্রক্রিয়ার একটি উদাহরণ হল শান্তাহার এবং বাগেরহাট অঞ্চলে দুইটি ১১৫ মেগাওয়াট ভারী জ্বালানি তেল (এইচএফও)-ভিত্তিক আইপিপি প্রকল্পের প্রত্যাখ্যান। আন্তর্জাতিক দরপত্রে এনার্জিস পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেডের মালিকানাধীন, এক্সেল ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড সর্বনিম্ন যোগ্য দরদাতা হিসেবে প্রকল্পগুলো জিতেছিল। বিপিডিবি একটি লেটার অফ ইনটেন্ট (এলওআই) এবং চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সুপারিশও করেছিল। কিন্তু বিগত হাসিনা সরকার প্রকল্পগুলো প্রত্যাখ্যান করে, যা টেন্ডার প্রক্রিয়ার ন্যায্যতা এবং বিদ্যুৎ খাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক সংযোগের প্রভাব প্রমাণ করে।
এছাড়াও বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো একাধিকবার সরকারের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। এর পাশাপাশি, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা গুটিকয়েক কোম্পানি নিয়েছে।
এই কেন্দ্রগুলোর মালিকরা বারবার সরকারকে একই বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিক্রি করে বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করেছে। ক্যাপাসিটি চার্জের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানি বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে গেছে, যা সরকারের বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখলে চুক্তি অনুযায়ী তাদের যে পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়, সেটারই আনুষ্ঠানিক নাম ক্যাপাসিটি চার্জ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিডিবি গত ১৫ বছরে বিদ্যুতের ভুল নীতির কারণে লোকসান গুনেছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে লোকসান প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ ১৫ বছর আগে বছরে লোকসান ছিল মাত্র ৮২৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে লোকসান দেয় ৫১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থ সরকারের অর্থ বিভাগ ধার হিসেবে দেয় পিডিবিকে। তবে অর্থ বিভাগের কাছে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় এখন পিডিবিকে টাকা দিতে পারছে না। কারণ, পিডিবি দেনা শোধ করে মার্কিন ডলারে। রিজার্ভের ওপর টান পড়ায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরাও পিডিবির কাছে বিদ্যুতের বিল পাবেন। বিগত সরকার বন্ড ইস্যু করেও পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারেনি।
সম্প্রতি পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবিকে লোকসান গুনতে হয় প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। এর আগের ১২ বছরে সংস্থাটি লোকসান গুনেছে ১ লাখ ৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার মোট যা লোকসান করেছে, তার চেয়ে বেশি লোকসান হয়েছে গত দুই অর্থবছরে।
এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার গত ১৪ বছরে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে মোট ৮৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে সরকারের মোট ব্যয় ৯০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পিডিবি কর্মকর্তাদের মতে, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাব যোগ করলে এই পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি হবে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে গত ১৩ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বৃহৎ পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। সামিট গ্রুপ সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা পেয়েছে, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ১২ শতাংশ। ১৩ বছরে বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র পাওয়ার শীর্ষে থাকা সামিট গ্রুপ। এই গ্রুপ গোপালগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের টানা ছয়বারের এমপি ও সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খানদের পারিবারিক ব্যবসা।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, পেয়েছে ৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। তৃতীয় স্থানে চীনা কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস, পেয়েছে ৭ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা।
দেশীয় কোম্পানির মধ্যে ইউনাইটেড গ্রুপ ৬ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা, বাংলাক্যাট ৫ হাজার ৬৭ কোটি টাকা, এবং খুলনা পাওয়ার কোম্পানি ৪ হাজার ৫৪ কোটি টাকা পেয়েছে। সামিট ও ইউনাইটেড গ্রুপের মধ্যে খুলনা পাওয়ারের শেয়ারের বড় অংশ রয়েছে।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কোম্পানির মধ্যে হোসাফ গ্রুপ ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা, মোহাম্মদী গ্রুপ ২ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা, এবং ডরিন গ্রুপ ২ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা পেয়েছে। ডরিন পাওয়ারের মালিক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে ও ঝিনাইদহ থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী তাহজীব আলম সিদ্দিকী।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য গত ৯ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে শুরু করে, ২০২১-২২, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৪ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে।
এছাড়াও ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য গত ৯ বছরে ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে এই চার্জের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা পৌঁছেছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে এবং ক্যাপাসিটি চার্জকে ‘লুটেরা মডেল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।
নিউ নেশনের অনুসন্ধান অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতির টাকার সম্ভাব্য অপব্যবহারের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাত থেকে রাঘববোয়ালদের অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিপর্যস্ত করার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, বিদ্যুৎ খাতে এই দুর্নীতি দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ও আইন-শৃঙ্খলা সংকট সৃষ্টি করতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ