April 20, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, January 20th, 2022, 9:35 pm

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক: ঘাটতি ও সম্ভাবনা

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বাংলাদেশ একটি ছোট আয়তনের জনবহুল রাষ্ট্র। ক্ষুদ্র সীমানার এই দেশটিকে পরিবেষ্টন করে আছে বিশালাকার দেশ ভারত। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বরাবরই বন্ধুপ্রতিম, যদিও দু’ দেশের মধ্যে কিছুকিছু ব্যাপার এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গের পর অধিকাংশ বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা এখন ভারতের অংশ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিরোধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতীয় বাঙালি সম্প্রদায় ও ভারত সরকারের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ পরবর্তী ফারাক্কা বাধ, সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা, চটগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের বিচ্ছনতাবাদিদের ভারতীয় সাহায্য সহ বিভিন্ন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য দুরত্ব থাকলেও বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক সার্বিক দিক দিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ। দুটি দেশই একই সাথে সার্ক, বিমসটেক, আইওরা এবং কমনওয়েলথের সাধারণ সদস্য। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বাঙ্গালীদের বসবাস যারা ১৯৪৬-৪৭এর দাঙ্গার পর পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) পরিত্যাগে বাধ্য হয় এবং বাংলাদেশ পাকিস্তানের অধীনস্থ হয়েছিল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী জোটের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে এবং আশির দশকের বিভিন্ন স্নায়ু যুদ্ধে এই সম্পর্ক আরও উন্নত হয়।[১][২] দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক উদারীকরণের সূত্রপাত সাথে তারা বৃহত্তর প্রবৃদ্ধি ও বাণিজ্যের উদ্ভাবন ঘটায়। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ভূমিকা রাখছে।
বলতে গেলে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গত পাঁচ দশকে এক বহুমাত্রিক পথ পাড়ি দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শক্তি ও জ¦ালানি, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির মতো নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিস্তৃত। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যকার সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ দুটি দেশের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মোড় পরিবর্তন হয়ে নতুন এক মাত্রা লাভ করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও উন্নতির কারণে তা সম্ভব হয়েছে।
জানা যায়, দুই দেশের এ বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও নতুন মাত্রায় নিতে আগ্রহী ভারত। এজন্য সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন বলেও জানা গেছে।
উল্লেখ্য, গত এক বছরে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেড়েছে ৯৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছর শেষে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি প্রথমবারের মতো ২০০ কোটি ডলার ছাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে পারলে দেশের জন্য তা যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য বয়ে নিয়ে আসবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ভারতের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থেকে দুটি পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সুবিধা লাভ করতে পারে: (১) দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মাধ্যমে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রসারিত করা এবং (২) এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যুক্ত হওয়া। বাংলাদেশ যখন উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে এগোচ্ছে এবং একই সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকেও তার উত্তরণ ঘটছে, সে সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তনের এ মুহূর্তে বাংলাদেশে তার নীতি ও কৌশল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে পারে।
এটি স্পষ্ট যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এমনি এমনি শক্তিশালী হয় না। এজন্য দেশীয় পর্যায়ে রফতানি উপযোগী খাত সমৃদ্ধ করার কোন বিকল্প নেই। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গত দশকজুড়ে দেশের বিভিন্ন খাতে নানা পদক্ষেপ লক্ষ্য করা গিয়েছে। এসব খাতের মধ্যে পণ্য, সেবা ও জ¦ালানি বাণিজ্য, বহুমাত্রিক পরিবহন মডেল, আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বৃদ্ধি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাণিজ্য বলতে এখন আর কেবল পণ্যভিত্তিক ব্যবসা বোঝায় না। সেখানে সেবা ও জ¦ালানি বাণিজ্য একটি বিশেষ জায়গা দখল করেছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা থেকে শুরু করে ডিজিটাল ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি স্থানান্তর ইত্যাদি বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় সড়ক, রেল ও উপকূলীয় নৌ-যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ফলে দুই দেশের মধ্যে অবাধ বহুমুখী যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল) মোটরযান চুক্তি, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের ট্রানজিট চুক্তি এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট চুক্তির মধ্য দিয়ে উল্লিখিত চারটি দেশের মধ্যে অবাধ যোগাযোগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মোংলা, চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
তবে এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশকে ভারতের সাথে বাণিজ্যিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ভারতের শুল্কমুক্ত বাজার ব্যবস্থায় প্রবেশ করার যে সুযোগ রয়েছে সেটি ব্যবহার করা। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ভারতে এক বিলিয়ন ডলারের রফতানি সীমা অতিক্রম করতে পেরেছে। কিন্তু এর পরিমাণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বাংলাদেশের বাজারের প্রতি ভারতের বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করা সম্ভব।
এক্ষেত্রে নিরাশার সংবাদও আছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সম্ভাবনা ও সুযোগের তুলনায় তার বাস্তবায়ন খুব সামান্যই। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের সম্ভাবনার আর্থিক পরিমাণ প্রায় ১৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আসলে হচ্ছে ১০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি উদ্বেগজনক, বিশেষত ঘাটতির পরিমাণ যেখানে প্রতি বছর বাড়ছে। বাংলাদেশে ভারতের একটি বৃহৎ ও বিকাশমান বাজার রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেখান থেকে এখন পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণে লাভবান হতে পারেনি। বৈশ্বিক বাজার থেকে ভারতের আমদানির মোট মূল্যমান প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ মাত্র ১ বিলিয়ন ডলার।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য পথ নিয়েও কিছু জটিলতা আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের প্রায় অর্ধেকটাই দুই দেশের স্থলবন্দরের মাধ্যমে হয়। সীমান্তের পয়েন্টগুলো মূলত কন্ট্রোল ও চেক পয়েন্ট। সে কারণে পণ্য কেবল ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ থেকেই বোঝাই ও খালাস করা হয়। এ কারণে বাণিজ্য দীর্ঘায়িত হওয়ার পাশাপাশি খরচ বৃদ্ধি পায়। এ ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে গ্রহণযোগ্য কোনো চুক্তি নেই। ফলে পণ্যগুলো পরীক্ষণ জটিলতায় বন্দরে বহুদিন পড়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে বহুদূরের ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করে আনা হয়। কিন্তু এর ফলে অনেক সময় চলে যায়। এ কারণে বাণিজ্য, পরিবহন ও বিনিয়োগ সংযোগের মাধ্যমে ত্রিমুখী ও একীভূত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ফলে উৎপাদন নেটওয়ার্ক উন্নত করে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অর্থনীতির স্বার্থ রক্ষা সহজ হবে বলে মনে করেন তাঁরা।