নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাস ভাড়া বাড়ানোর পর তার চেয়েও বেশি আদায়ের যে ‘নৈরাজ্য’ সড়কে চলছে, তার খতিয়ান তুলে ধরে বেশ কিছু প্রস্তাব রেখেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গত বৃহস্পতিবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে চিঠি দিয়ে প্রস্তাবগুলো তুলে ধরা হয়েছে বলে সমিতির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। সমিতি বলছে, বিইআরসি আইন ‘লঙ্ঘন করে’ জ¦ালানি তেলের দাম একলাফে ১৫ টাকা বৃদ্ধির পর বাস ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দামে ডিজেল বিক্রির পরেও সেখানে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। দেশের গণপরিবহনগুলো আগে থেকেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করে আসছিল জানিয়ে গ্রহণযোগ্য ভাড়া নির্ধারণ এবং তা বাস্তবয়নের জন্য হস্তক্ষেপ চেয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোয় পরিবহন ধর্মঘটে তিন দিন বাস বন্ধ ছিল। সরকার দূরপাল্লার বাসে ২৭ শতাংশ এবং ঢাকায় ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর পর সোমবার বাস চলাচল শুরু হয়। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ ওঠায় সরকার এখন রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ আদালত নামিয়ে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা করছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির চিঠিতে বলা হয়, ২০১৬ সালে জ¦ালানি তেলের মূল্য লিটারে ৩ টাকা কমানোর পর বাস ভাড়া কমানো হয় প্রতি কিলোমিটারে ৩ পয়সা। ঠিক সেভাবে এবার তেলের দাম ১৫ টাকা বাড়ায় প্রতি কিলোমিটারে যাত্রী প্রতি ভাড়া ১৫ পয়সা বাড়ানো যেত। তা না করে অধিকহারে ভাড়া বৃদ্ধির কারণে গণপরিবহন ব্যবহারকারী নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর যাত্রীস্বার্থ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে অকটেন-পেট্রোলের দাম না বাড়িয়ে সরকার বড়লোকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছে। যা অযৌক্তিক ও গণবিরোধী। সরকার কেবল ডিজেলচালিত বাস ভাড়া বাড়ালেও সিএনজিচালিত বাসেও যে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, সে কথা তুলে ধরে চিঠিতে বলা হয়, সারাদেশে দুরপাল্লা, আন্তঃজেলা, সিটি সার্ভিস ও শহরতলীতে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের পাশাপাশি হিউম্যান হলার, অটো-টেম্পোসহ সকল প্রকার ভাড়ায় চালিত গণপরিবহনের গ্লাসের সামনে সহজে দৃশ্যমানভাবে বাস মালিকদের নিজ দায়িত্বে ডিজেলচালিত, অকটেনচালিত, পেট্রোলচালিত, সিএনজিচালিত লেখা স্টিকার লাগাতে হবে। তাছাড়া বিআরটিএ, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ, হাইওয়ে পুলিশ বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার কথা বলে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করার অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে। সেখানে বলা হয়, ঢাকার গুলিস্থান থেকে বাসে উঠে কোনো যাত্রী পল্টন বা প্রেসক্লাব বা শাহবাগে নামলেও তার কাছ থেকে ফার্মগেটের ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। একইভাবে ফার্মগেট থেকে উঠে কোন যাত্রী খামারবাড়ি বা আগারগাঁও নামলেও তার কাছ থেকে মিরপুর-১০ পর্যন্ত দূরত্বের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। মালিকরা দৈনিক জমার ভিত্তিতে চালক-সহকারী হাতে বাস ছেড়ে দেওয়ায় সেই টাকা তুলতে তারা বেশি ভাড়া আদায় করছে বলে মনে করছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। আর এ ধরনের ‘বেআইনি’ কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে চিঠিতে। ঢাকা মহানগরীর বেশ কয়েকটি রুটের বাসভাড়া আদায়ের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে চিঠিতে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-
ঢাকার কেরানীগঞ্জের কদমতলী থেকে গুলিস্থানের দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। এ রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়া বাসে ৭ টাকা, মিনিবাসে ৫ টাকা। কিন্তু আগেই কোনো বাসে ১০ টাকা, কোনো বাসে ১৫ টাকা আদায় করা হত। এখন ভাড়া বাড়ানোর পর ১০ টাকার জায়গায় ১৫ টাকা, আর ১৫ টাকার জায়গায় ২০ টাকা আদায় করছে বাসগুলো। গুলিস্তান থেকে শাহবাগ সাড়ে ৩ কিলোমিটার যাত্রাপথে আগে থেকে যেসব বাস ১০, ১৫, ২৫ টাকা ভাড়া আদায় করত, তারা এখন ১৫, ২০, ৩৫ টাকা হারে ভাড়া আদায় করছে। গুলিস্তান থেকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার পার হয়ে কাজলা ৬ কিলোমিটার পথের ভাড়া ছিল মিনিবাসে ১০ টাকা ও বড় বাসে ২০ টাকা। ভাড়া বৃদ্ধির পর থেকে এ পথে মিনিবাসে ২০ টাকা বড় বাসে ২৫ টাকা ভাড়া যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরত্বে যাতায়াতকারী যাত্রীদের সংখ্যা ৬০ শতাংশের বেশি। অথচ তাদের জন্য নূন্যতম ভাড়া হিসেবে বেশি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। আদায় করা হচ্ছে তারচেয়ে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি। গুলিস্তান থেকে মিরপুরগামী বাস-মিনিবাসে আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, মিরপুর-১০ আগে ভাড়া আদায় করা হত ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা। ভাড়া বৃদ্ধির পর এখন ৩৫ থেকে ৪০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। মিরপুর থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার পথে আগে মিনিবাসের নির্ধারিত ভাড়া ছিল ৩৫ টাকা, বাসে ৩৭ টাকা। তখন সকল বাসে আদায় করা হত ৫৫ টাকা। ভাড়া বৃদ্ধির পর এই পথে আদায় হচ্ছে ৭০ টাকা ভাড়া, যদিও বর্তমানে সরকার নির্ধারিত হারে বড় বাসে ৪৭ টাকা, মিনিবাসে ৪৫ টাকা আদায় করা কথা। যাত্রাবাড়ী থেকে মদনপুর ১০ কিলোমিটার পথে ১৫ টাকা ভাড়ার জায়গায় আগে ২০টাকা নেওয়া হত, ভাড়া বৃদ্ধির পর নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। মোহাম্মদপুর থেকে জিগাতলা ৩ কিলোমিটার পথে সরকার নির্ধারিত ৫ টাকার জায়গায় আগে আদায় হত ১০ টাকা, এখন নিচ্ছে ১৫ টাকা। জিগাতলা থেকে শাহবাগ আগে ১০ টাকা নিত, এখন ১৫ টাকা।
সমিতি বলছে, দূরপাল্লার বাসের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে পুরোনো বাস এবং নতুন বাসে আলাদা আলাদা ভাড়া নির্ধারণ জরুরি। বিগত ১২ বছরে সরকার সড়ক-মহাসড়কে ধারাবাহিক উন্নয়ন কর্মকা-ের ফলে সড়কে গতি বেড়েছে। ফলে ট্রিপ বাড়ানোর মধ্যে দিয়ে মালিকের আয় বেড়েছে। অনেক জাতীয় মহাসড়কে দূরত্ব কমেছে। ভাড়া নির্ধারণ ও তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বাস মালিকদের সংখ্যানুপাতে যাত্রী সংগঠন ও ক্যাবের প্রতিনিধি রেখে বাস ভাড়ার ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি পুনর্গঠন করারও দাবি জানিয়েছে সমিতি।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম