নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিশ্বের জনবহুল মেগাসিটির মধ্যে ঢাকার অবস্থান অন্যতম। প্রতিনিয়ত এই নগরে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণ। শব্দদূষণ, মাটিদূষণ আর বায়ুদূষণে এই নগরের অবস্থা নাজেহাল। তবে এই দূষণগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণ বেশি ভোগাচ্ছে এই নগরের বাসিন্দাদের। ভপ্যানকভাবে বায়ুদূষণে আক্রান্ত এই নগরের বাসিন্দারা আক্রান্ত হচ্ছে নানা ধরণের দূষণজনিত রোগে। বায়ুদূষণে এই শহর এখন শীর্ষে অবস্থান করছে। এই শীর্ষাবস্থানের পতন না হলে এই নগরে যে বাস করা অসম্ভব হয়ে যাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
গ্রামাঞ্চলের প্রকৃতি শীতকালে কুয়াশায় আবৃত থাকে। কিন্তু ঢাকায় সবসময় কুয়াশা লেগে থাকে। ধূলার কুয়াশা। এই নগরের বাসিন্দারা বুকভরে শ্বাস নিতে পারে না। জানা যায়, শীতের শুরু থেকেই বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা প্রায়ই উঠে আসছে বিশ্বের শীর্ষে। গত বছরের তুলনায় এ বছর শীত মৌসুমে ঢাকায় বায়ুদূষণ বেড়েছে ১৯ শতাংশ। বাতাসের বিষে চরম ঝুঁকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। গবেষণায় উঠে এসেছে, নানা রকম দূষণে বাংলাদেশে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে এক লাখ ২৩ হাজার মানুষ।
এই যে বায়ুদূষণে প্রতিবছর এত মানুষ মারা যাচ্ছে কিন্তু তারপরও নেই কোন সচেতনতা, নেই বায়ুদূষণ প্রতিরোধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ। ‘নির্মল বায়ু আইন’ নামে একটি আইন বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য খসড়া তৈরির দুই বছর পার হলেও ‘নির্মূল বায়ু আইন’ পাস হয়নি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর ছয় মাস। লাইফ ইনডেক্সের গবেষণা মতে, ১৯৯৮ সালে বায়ুদূষণের কারণে গড় আয়ু কমেছিল প্রায় দুই বছর আট মাস, ২০১৯ সালে সেটি পাঁচ বছর চার মাসে দাঁড়ায়। গবেষণা বলছে, সারাদেশে বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী অন্তত তিনগুণ বেশি। দূষিত বাতাসে কঠিন ও তরল পদার্থ উড়ে বেড়ায়, যার মধ্যে রয়েছে কাচ, ধোঁয়া বা ধুলা। যা ‘বস্তুকণা’ হিসেবে পরিচিত। বস্তুকণার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বলা হচ্ছে-বস্তুকণা ২.৫। যা মানুষের চুলের ব্যাসের মাত্র তিন শতাংশ, যেটি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। বছরজুড়েই ঢাকার বাতাসে ‘বিষ’ উড়ে বেড়ায়। বায়ুদূষণে মানুষের আয়ু গড়ে তিন বছর কমছে। বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে চতুর্থ প্রধান কারণ এখন বায়ুদূষণ।
জানা যায়, রাজধানীর বায়ুদূষণজনিত এলাকাগুলোর মধ্যে খারাপ অবস্থায় আছে পুরান ঢাকা। এরপর আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি, গুলশান, বাড্ডা ও বনানীতে দূষণের মাত্রা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। সবচেয়ে বেশি দূষিত এলাকা হচ্ছে এখন বারিধারা-আমেরিকান অ্যাম্বাসির কাছাকাছি এলাকা। এ ছাড়া মিরপুর, আগারগাঁও, গাবতলী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, মহাখালী, বিজয়নগর, মতিঝিল ও গুলিস্তানে দূষণ দিনের পর দিন বাড়ছে। নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত পুরো সময়টায় দূষণের মাত্রা থাকে বিপজ্জনক অবস্থায়। আর বাকি পাঁচ মাস থাকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায়। যার অর্থ ঢাকা শহরের সবাই ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় দূষণ বাড়ার উপযোগী উপাদান দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে উন্নয়ন কর্মকা, ইটভাটা, বর্জ্য পোড়ানো, কলকারখানা ও গাড়ির কালো ধোঁয়া দূষণের জন্য দায়ী। ২০১৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণা বলছে, ঢাকায় বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ শতাংশ, রোড ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮, যানবাহন ১০, বায়োমাস পোড়ানো ৮ এবং অন্যান্য উৎস ৬ শতাংশ দায়ী।
তবে এর পেছনে আরও নানাবিধ কারণ বিদ্যমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের গত বছরের এক জরিপ বলছে, বায়ুদূষণের জন্য অর্ধেক (৫০ শতাংশ) দায়ই তরল জ¦ালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া ধোঁয়ার। ৪০ শতাংশ দূষণের উৎস খড়, কাঠ, তুষের মতো জৈব বস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ণ বস্তুকণা। বাকি ১০ শতাংশ দূষিত বস্তুকণা আসে ইটভাটায় কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া থেকে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, সারাদেশে ইটভাটা আছে প্রায় ৮ হাজার। আর ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে রয়েছে সাড়ে ৭০০টির বেশি ইটভাটা। ইটভাটাগুলো প্রতি মৌসুমে ২৫ লাখ টন কয়লা ও ২২ লাখ টন জ¦ালানি কাঠ পোড়ায়। ইটভাটার দূষণে ৮৮ লাখ ৮৬ হাজার টন গ্রিন হাউস গ্যাস হয়। ঢাকায় বায়ুদূষণের জন্য এককভাবে ইটভাটা প্রায় ৫৮ শতাংশ দায়ী। এ ছাড়া নির্মাণকাজ, যানবাহন, সড়ক ও মাটি থেকে সৃষ্ট ধুলার মাধ্যমে ১৩ শতাংশ, বিভিন্ন জিনিসপত্রসহ প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে ৫ শতাংশ এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের দূষিত বায়ু পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার হয়ে ঢাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে ২৪ শতাংশ দূষণে ভুগছে ঢাকা। নাসার তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়েছে ৮৬ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইপিএর হিসাবে, কোনো একটি শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০ হলে তাকে অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। এটি নগরবাসীর প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়, একে স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ তা জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যান্যের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি থাকা মানে ওই স্থানের বায়ু ‘বিপজ্জনক’। ঢাকার বায়ুমান বছরের পাঁচ মাস অস্বাস্থ্যকর থেকে বিপজ্জনক থাকে।
বছরের অর্ধেক সময় অস্বাস্থ্যকর এবং বাকি অর্ধেক সময় বিপজ্জনক সীমায় থাকা এই শহরে বায়ুদূষণের কারণে সিংহভাগ মানুষ নানাবিধ স্বাস্থ্যজটিলতায় ভুগছেন বলে জানা যায়। চিকিৎসকরা বলছেন, দূষণের জেরে শুধু ফুসফুসই নয়, ঝুঁকির মুখে পড়ছে নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। দেশের বাতাসে সবচেয়ে বিপজ্জনক পিএম ২.৫-এর পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা পরিমাণের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি।
সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হচ্ছে যে, দূষণ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এত পদক্ষেপ নেওয়ার পরও বায়ুদূষণে রাজধানী ঢাকা কেন বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ স্থান দখল করলো তা সাধারণ মানুষ বুঝে উঠতে পারছে না। এ বিষয়ে দেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের ভাষ্য, দূষণ কমাতে আমরা ব্যাপক কাজ করছি। গত দেড় বছরে অবৈধ ইটভাটাগুলোর ৬২ শতাংশ বন্ধ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক