নিজস্ব প্রতিবেদক:
ফারমার্স ব্যাংক থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহাকে ঋণ আত্মসাতের দায়ে চার বছর ও মানি লন্ডারিংয়ের আরেক ধারায় সাত বছরসহ মোট ১১ বছরের কারাদন্ডদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে ৪৫ লাখ টাকা অর্থদ- এবং তা দিতে ব্যর্থ হলে অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। দুই দফা পেছানোর পর ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম মঙ্গলবার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আদালত বলেছেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি হয়েছেন ২২ জন। এর মধ্যে সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহাই প্রথম প্রধান বিচারপতি দুর্নীতির মামলায় যাকে কারাদ- দিলেন আদালত। প্রধান বিচারপতি তো দূরের কথা, এর আগে কোনো বিচারপতিরও কারাদন্ড হয়নি।
এর আগে গত ৫ অক্টোবর এ মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু, বিচারক অসুস্থ থাকায় তারিখ পিছিয়ে পরবর্তী রায় ঘোষণার জন্য ২১ অক্টোবর দিন ধার্য করা হয়। পরবর্তীকালে বিচারক রায় প্রস্তুত করতে না পারায় মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) নতুন দিন ধার্য করেন বিচারক।
২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর এস কে সিনহা শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে চলে যান। এরপর আর তিনি দেশে ফেরেননি।
২০১৯ সালের ১০ জুলাই দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন ১১ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন এস কে সিনহা, ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীম, সাবেক এসইভিপি ও সাবেক ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায় ও সাফিউদ্দিন আসকারী, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান, নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও তাঁর স্ত্রী সান্ত্রী রায়।
এরপর ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ। এর আগে ওই বছরের ৪ ডিসেম্বর কমিশনের সভায় ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র অনুমোদন দেওয়া হয়। অভিযোগপত্র প্রস্তুতের আগে মৃত হিসেবে প্রমাণ মেলায় এক আসামির নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও নতুন একজনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
যার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে তিনি হলেন ফারমার্স ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও গুলশান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ। অপরদিকে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ব্যাংকটির অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীকে।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন এস কে সিনহা। প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগে থেকেই নানা কারণে আলোচিত ছিলেন তিনি। দায়িত্ব পালনের দুই বছরেও বারবার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন নানা ঘটনায়। বয়স ৬৭ বছর পূর্ণ হলে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক পরিস্থিতির মধ্যে ৮২ দিন আগেই তার কার্যকাল শেষ হয়।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের তোপের মুখে ছুটি নিয়ে ১৪ অক্টোবর বিদেশ যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি সেখানে থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তিনি ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম, নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে। বলা হয়, ওই সব অভিযোগের কারণে আপিল বিভাগের অন্য বিচারকরা আর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসে মামলা নিষ্পত্তিতে রাজি নন। সেসব অভিযোগ নিয়ে দুদক পরে অনুসন্ধান শুরু করে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ২০১৮ সালে বিচারপতি সিনহা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘আ ব্রোকেন ড্রিম’ নামে একটি আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশ করেন। তাতে তিনি দাবি করেন, তাকে ‘পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে’ পাঠানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, মামলার ১১ আসামির মধ্যে শুধু বাবুল চিশতী কারাগারে ছিলেন। রায়ের আগে তাকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। এ ছাড়া জামিনে থাকা একেএম শামীম, স্বপন কুমার, লুৎফুল হক, সালাহউদ্দিনসহ ছয়জন আদালতে হাজির ছিলেন। আসামি সাফিউদ্দিন, রণজিৎ ও তার স্ত্রী শান্তি রায় সিমি পলাতক রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
১৮২ পৃষ্ঠার রায়ে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে নিজেরা লাভবান হয়ে এবং অন্যান্যের লাভবান করতে এ ধরনের অপরাধ করেছেন। এ ছাড়া ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের যে ‘ক্রেডিট পলিসি’ রয়েছে, প্রভাব খাটিয়ে তা লঙ্ঘন করে সাবেক প্রধান বিচারপতির জন্য ঋণ অনুমোদন করা হয়েছিল। সেই অর্থ পাচার হয়েছিল, সেটাও এ মামলায় প্রমাণিত হয়েছে।
এদিকে, সাবেক প্রধান বিচারপতির কারাদন্ডের রায় ‘সুখকর নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। মঙ্গলবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে তিনি বলেন, ‘আমি খুব খুশি হতে পারছি না। তার কারণ হচ্ছে, উনি বিচার বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। উনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন। আমি একজন আইনজীবী, সারা জীবন বিচার বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমার জন্য এটা সুখকর হতে পারে না।’
কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জেলহত্যা মামলা, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধদের বিচার ও অন্য সব দুর্নীতির যে বিচারগুলো হয়েছে, তাতে প্রমাণিত হয়েছে, দেশে আইনের শাসন আছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ