নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঘনঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটে বিপাকে পড়েছেন রংপুর বিভাগের ৮ জেলার বাসিন্দারা। গত কয়েক মাস ধরে বিদ্যুতের ঘনঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে বিভাগবাসীর জনজীবন। দিনে ১০-১২ বার বিদ্যুৎ বিভ্রাট যেন সাধারণ ব্যাপার। তবে গত দু’সপ্তাহ ধরে এর মাত্রা বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে করে কলকারখানায়ও উৎপাদন বিঘিœত হচ্ছে।
সরবরাহ সংকটের কারণে বিদ্যুৎ বিতরণে হিমশিম খাচ্ছে বিতরণ কোম্পানি নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো) ও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিআরইবি)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়লা ও ফার্নেস অয়েলের সরবরাহ কমে যাওয়ায় এ অঞ্চলের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না। অন্যদিকে সঞ্চালন অবকাঠামোর দুর্বলতার কারণে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ এনেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট কমানো যাচ্ছে না।
লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ গ্রাহকদের সমস্যার পাশাপাশি শিল্প এলাকাসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দুই মাস ধরে চলমান এ সংকট নিরসনে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো কাজ করলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিগগিরই এর সমাধান হচ্ছে না। মূলত কয়লা সংকটের কারণে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ ও বিশ্ববাজারে ফার্নেস অয়েলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ¦ালানি সংকটে পড়েছে। ফলে তাদের উৎপাদন কমে গেছে। যার কারণে সরবরাহ ও বিতরণে এর প্রভাব পড়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, রংপুর বিভাগের আট জেলায় দুটি বিতরণ কোম্পানির আওতায় গ্রাহক সংখ্যা ৪২ লাখ। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক ৩৫ লাখ ও নেসকোর গ্রাহক সংখ্যা সাত লাখের কিছু বেশি। এসব গ্রাহকের দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ৮৫০ মেগাওয়াট। সেখানে এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ৭০০ মেগাওয়াট। ফলে প্রতিদিন ১৫০ মেগাওয়াটের মতো ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে, যা লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে সমন্বয় করা হচ্ছে।
রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পিডিবির মোট সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যেগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা ৬০৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে, যেগুলোর মোট সক্ষমতা ২০১ মেগাওয়াট। অন্যদিকে কয়লা ও জ¦ালানি তেল সংকটে ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। যেগুলো চালু রয়েছে সেগুলো হলো ৮০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র কনফিডেন্স পাওয়ারের ১১৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় অবস্থিত আট মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র।
পিডিবির দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার দিনের বেলায় পিক আওয়ারে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২০১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। রাতের পিক আওয়ারে উৎপাদন হয়েছে ১৯৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অর্থাৎ চাহিদার মূল অংশটুকুই আনতে হচ্ছে জাতীয় গ্রিড থেকে।
আরইবি ও নেসকোর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এ অঞ্চলের সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতাসহ নানা কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
এ বিষয়ে পিডিবির সদস্য (বিতরণ) শামসুল আলমের ভাষ্য, বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ থাকায় রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে। কয়লা সংকটের কারণে মূলত এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় একটি সক্ষমতা বসে আছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সমস্যা থাকলেও সেটি নিরসন হয়েছে। আশা করছি সামনে শীত মৌসুমে এ সংকট কিছুটা কমে আসবে।
উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট দীর্ঘদিনের। শিল্প-কারখানার পরিমাণ কম বিবেচনায় উত্তরাঞ্চলে কম বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে সরকার। তবে কয়েক বছর ধরেই এ অঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ হলেও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা যায়নি। আবার এ অঞ্চলের সঞ্চালন অবকাঠামোও পুরনো। ফলে বেশির ভাগ সময় জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে সরবরাহ করা হলেও অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাননি সেখানকার গ্রাহকরা। নেসকো ও আরইবির গ্রাহকরা বলছেন, সারা দেশেই বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের খবর তারা পান। কিন্তু রংপুর বিভাগের গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাননি, সেদিক থেকে তারা অবহেলিতই রয়ে গেছেন। বিদ্যুতের পিক আওয়ারে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়। বিশেষত গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেলে এ অঞ্চলের মানুষের অসহনীয় ভোগান্তি শুরু হয়।
এ ব্যাপারে নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জাকিউল ইসলাম বলেন, উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে গ্রাহক অসন্তুষ্টির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও লো-ভোল্টেজ। প্রতিনিয়ত চাহিদার বিপরীতে ১০০-১৫০ মেগাওয়াট লোডশেড হচ্ছে। গ্রাহকরা এসব নিয়ে ক্ষুব্ধ, তবে আমরাও চেষ্টা করছি পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের।
এ অঞ্চলের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে আরো কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ ও লো-ভোল্টেজ নিরসনে ক্যাপাসিটর ব্যাংক স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বিদ্যুতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল। সংস্থাটির মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, এরইমধ্যে এনার্জিপ্যাক ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। পাশাপাশি ভোল্টেজ ড্রপ যাতে না হয়, সেজন্য ক্যাপাসিটর ব্যাংক বসানো হচ্ছে। এসব কাজ শেষ হলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিরসন হবে। তিনি আরো বলেন, উত্তরাঞ্চলে তেল পরিবহনে সমস্যা থাকায় সেখানে বড় ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা যাচ্ছে না। যে কারণে এসব সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে রূপপুরের মতো বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে গেলে এ সমস্যা আর থাকবে না।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি