নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি শূন্য করে ফেলছে বিপুলসংখ্যক গভীর নলকূপ। যদিও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএমডিসি) বিগত ২০১৪ সাল থেকেই গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ রেখেছে। কিন্তু তাতেও বন্ধ নেই ব্যক্তিমালিকানায় পাম্প বসানো। বরং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই পাম্প চালানো হচ্ছে। বর্তমানে ওই এলাকার বেশির ভাগ সেচের পানি ব্যক্তি উদ্যোগে বসানো গভীর নলকূপ থেকে সরবরাহ হয়। আর তাদের দাবি, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএমডিসি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বরেন্দ্রজুড়েই তীব্র হয়ে উঠেছে আবাদি জমিতে সেচের পানি সংকট। সেজন্য অনেকেই গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলার কারণে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিএমডিএ) দায়ি করে। তবে বিএমডিএ সংশ্লিষ্টদের মতে, পরিবেশগত ঝুঁকি টের পেয়ে ২০১৪ সাল থেকে গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ রাখা হয়েছে। মূলত সেচ সংকটের পেছনে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের ব্যাপক হারে গভীর নলকূপ স্থাপন করে পানি উত্তোলনই দায়ি। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার অধিকাংশ এলাকা এবং নাটোরসহ বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কিছু এলাকা নিয়ে গঠিত বরেন্দ্র অঞ্চল। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় ওই অঞ্চলের কৃষি আবাদের সুবিধার জন্য ১৯৮৫ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমীক্ষার পর রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় গভীর নলকূপ বসানো শুরু হয়। প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের ২ লাখ ২৫ হাজার একর জমি সেচের আওতায় আনা। ১৯৮২ সালে ইউএনডিপি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বরেন্দ্র জোনকে জিরো এক্যুইফার হিসেবে দেখানো হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, ওই এলাকার ভূগর্ভস্থ স্তরে শুধু গৃহস্থালির প্রয়োজন মেটানোর মতো পানি রয়েছে। তারপর ১৯৮৫ সালে বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষা চালায় পানি উন্নয়ন বোর্ড। সংস্থাটি কারিগরি প্রতিবেদনে জানায়, শুধু হস্তচালিত গভীর নলকূপে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভ থেকে পানি তোলা সম্ভব। ওই বছরই বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সোয়া দুই লাখ একর জমি সেচের আওতায় আনার লক্ষ্যে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় গভীর নলকূপ বসানো শুরু হয়। তার মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা ১১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৭৬ শতাংশে উন্নীত হয়। একপর্যায়ে ওই প্রকল্প বিএমডিএ নামে স্থায়ী রূপ পায়। বর্তমানে বিএমডিএ ১৫ হাজার ৫৫৩টি গভীর নলকূপে পানি তুলছে।
সূত্র জানায়, বিএমডিসির ক্ষুদ্র সেচ সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০১৯-২০ অনুযায়ী রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় মোট ১ লাখ ৪ হাজার ৮৫৮টি সেচ পাম্প রয়েছে। তার মধ্যে ৮ হাজার ৫২৫টি বিএমডিএর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। বাকি ৯৬ হাজার ৩৩৩টি পাম্প ব্যক্তিমালিকানায় চলছে। ওই তিন জেলার ৫ লাখ ৭ হাজার ১৪৫ হেক্টর জমি সেচের আওতায় এসেছে। তার মধ্যে বিএমডিএ ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৬১ হেক্টর জমিতে সেচ দিচ্ছে। বাকি ২ লাখ ১১ হাজার ৩৮৬ হেক্টর জমিতে ব্যক্তিগত সাবমার্সিবল পাম্প (এসটিডব্লিউ) থেকে সেচ দেয়া হচ্ছে। নওগাঁয় সবচেয়ে বেশি ৫৩ হাজার ৯২৩টি ব্যক্তিমালিকানার পাম্প রয়েছে। ওই জেলার সেচের ৫১ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন পাম্পের দখলে এবং বাকি ৪৯ শতাংশ জমি বিএমডিএর সেচ পাম্প থেকে সেচ পাচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীতেও একই চিত্র। রাজশাহীতে ২ হাজার ৮৫২টি বিএমডিএর পাম্প চললেও এসটিডব্লিউ চলছে ২৭ হাজার ১০৫টি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১ হাজার ৫৮৩টি বিএমডিএর পাম্পের পাশাপাশি ১৫ হাজার ৩১৫টি এসটিডব্লিউ চলছে।
সূত্র আরো জানায়, বিএমডিএর নিয়ামতপুর জোনে গভীর নলকূপ স্থাপনের হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই। বছর দুয়েক আগের হিসাবে উপজেলায় বিএমডিএ পরিচালিত গভীর নলকূপ ছিল ৬৯৪টি। তাছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন ১৯২টি গভীর নলকূপ এবং ৮৩৩টি এসটিডব্লিউ ছিল। কিন্তু ওই দুই বছরে ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ ও এসটিডব্লিউর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। রসূলপুর ইউনিয়নে দুই বছর আগে ১৩৫টি গভীর নলকূপের পাশাপাশি ১৪২টি এসটিডব্লিউ বসানো হয়েছে। সম্প্রি রাজনৈতিক চাপে প্রচুর এসটিডব্লিউ বসানো হয়েছে। কেউ কেউ জমির পরিমাণ বেশি দেখিয়ে একাধিক এসটিডব্লিউ বসিয়েছে। কোথাও কোথাও তারা বিএমডিএর সেচের অধিক্ষেত্রেও ভাগ বসাচ্ছে। কিন্তুবিএমডিএ কিছুই করতে পারছে না।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাদের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। বরেন্দ্র অঞ্চলেই দেশের একমাত্র তিনফসলি জমি। সেখানে সেচের ক্ষেত্রে নানা চ্যালেঞ্জ আছে। ওই এলাকায় জাতীয় গড় বৃষ্টিপাতের প্রায় অর্ধেক বৃষ্টিপাত হয়। আর একবার বৃষ্টি হলে দীর্ঘদিন খরা যায়। ফলে ফসল বাঁচাতে কৃষকদের প্রচুর ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে হয়। সেজন্যই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ পড়ে।
অন্যদিকে বরেন্দ্রজুড়ে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটির সদস্য ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজলের মতে, বিধিনিষেধের কারণে বিএমডিএ আর গভীর নলকূপ বসাচ্ছে না। কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগ থামানো যাচ্ছে না। তাদের থামানোর জন্য দেশে পানি আইন ও পানি বিধিমালা রয়েছে। সেটা সরকার বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগী না হলে সর্বনাশা কার্যক্রম থামবে না। তার সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব জড়িত। ফলে আইন না মেনেই সংশ্লিষ্ট যে দপ্তরগুলোর কাজ করার কথা তাদের তোয়াক্কা না করেই বা চাপ প্রয়োগ করে গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদ জানান, ভূগর্ভস্থ সেচ কার্যক্রম বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ শুরু করলেও এখন প্রযুক্তির হাতবদল হয়েছে। সেচের গুরুত্ব বাড়ায় ব্যক্তিমালিকানায় ছোট গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে। এমনকি বরেন্দ্র সেচের অধিক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে এমন গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। কোনোভাবে তা থামানো যাচ্ছে না। এখন রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় ৫৮ শতাংশ পানি তোলে বিএমডিএ। বাকি ৪২ শতাংশ পানি তোলে ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ। সেচ ছাড়াও ভূগর্ভস্থ পানি কলকারখানায় ব্যবহার হচ্ছে। মাছ চাষের জন্য পুকুরেও ব্যবহার হচ্ছে। পরিবেশগত ঝুঁকি বিবেচনায় ২০১৪ সালে গভীর নলকূপ স্থাপন বন্ধ করে কেবল পুরনোগুলো মেরামত করে চালু রাখা হয়েছে। কারণ সেটি না হলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। বর্তমানে ভূ-উপরিস্থ সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। পদ্মা মহানন্দা আত্রাই নদীর পানি তুলে সেচের কাজে লাগানো হচ্ছে। বৃষ্টির পানি আহরণে বড় বড় পুকুর-দিঘি এবং খাল পুনর্খনন হচ্ছে। এখন সেচের প্রায় ১০ শতাংশ পানি ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে আসছে। ধীরে ধীরে ভূ-উপরিস্থ সেচের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ