November 18, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, October 15th, 2023, 7:40 pm

বিয়ানীবাজারে ফের শুরু হয়েছে নদী ভাঙ্গন, হুমকির মুখে বহু স্থাপনা

জেলা প্রতিনিধি, সিলেট:

বিয়ানীবাজার উপজেলার বুক চিরে বয়ে গেছে কুশিয়ারা, সুরমা ও সোনাই নদী। এই নদীগুলোই মূলত: বিয়ানীবাজারকে শাসন করছে। কখনো ভাঙ্গনের রুদ্রমূর্তি আবার কখনো বন্যার পানির চোখ রাঙ্গানিতে তটস্থ থাকেন উপজেলার প্রায় পৌনে ৩ লাখ বাসিন্দা। ভাঙ্গন ঠেকানোর যথাযথ উদ্যোগ না নেয়ায় এতদঞ্চলের মানুষের বসতভিটা, হাটবাজার, স্কুল, মসজিদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নদীর পেটে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

কখনো কোনো এলাকা অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে শোরগোল শুরু হলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা আসেন, ছবি তোলেন। কিন্তু ভাঙ্গনরোধে কোনো কাজ হয় না। গত প্রায় এক দশক থেকে এই অঞ্চলে বর্ষা কিংবা শুষ্ক মৌসুমে নদীর ভাঙন চলছেই। একইসাথে চলছে ভাঙ্গনের শিকার নদী তীরবর্তী হাজারো মানুষের আহাজারি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের সাতটিই নদী ভাঙ্গনে ক্ষয়ক্ষতির শিকার। এখানকার চারখাই ও আলীনগর ইউনিয়নের অন্তত: ১২টি গ্রাম সুরমা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্থ। বিগত দিনে বালুভর্তি বস্তা নদীর তীরে ফেলে প্রাথমিকভাবে ভাঙ্গন রোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তা কোন সুফল বয়ে আনেনি।

বিয়ানীবাজারের শেওলা, দুবাগ ও কুড়ার বাজার ইউনিয়নের বহু স্থাপনা কুশিয়ারা নদীর করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা নদী ভাঙ্গনের কবলে রয়েছে কয়েক বছর থেকে। চলতি মৌসুমেও ভাঙ্গন অব্যাহত থাকায় বিলীন হওয়ার পথে সুরমা-কুশিয়ারা-সোনাই নদীবিধৌত এখানকার অন্তত: ৪০টি গ্রাম।

সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নের নয়াদুবাগ, চরিয়া, হাজরাপরা, গয়লাপুর, মইয়াখালীসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম বিপর্যয়ের মুখে। শেওলা ইউনিয়নের কাকরদিয়া ও তেরাদল এবং কুড়ারবাজার এলাকার আঙ্গারজুর গ্রামের সড়ক নদীতে বিলীন হয়েছে। তেরাদল গ্রামের মসজিদও রয়েছে হুমকিতে। এ ছাড়া আরও প্রায় ২০টি গ্রামে ভাঙ্গন চলছে। শীতকালে নদীর পানি শুকিয়ে গেলে এসব এলাকায় ভাঙ্গনের মাত্রা তীব্র হয়। ইতোমধ্যে ভাঙ্গনকবলিত এলাকার রাস্তা, বসতবাড়ি, মসজিদ, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কবরস্থানসহ ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে।

শেওল ইউনিয়নের কাকরদিয়া, তেরাদল এবং কুড়ারবাজার ইউনিয়নের আঙ্গারজুর এলাকায় নদীভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে গ্রামের চলাচলের একমাত্র রাস্তা। এলাকাবাসী বিভিন্ন বাড়ির আঙিনা দিয়ে চলাচল করছে। কাকরদিয়া গ্রামের জামে মসজিদে ফাটল দেখা দিয়েছে। যেকোনো সময় মসজিদটি নদীতে চলে যাবে।

কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গনের কবলে রয়েছে কুড়ারবাজার ইউনিয়নের আকাখাজানা, লাউঝারি, আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর, গোবিন্দ্রশ্রী, দেউলগ্রাম ও গড়বন্দ গ্রামের বসতি, রাস্তা, কবরস্থান ও বাজার। কুড়ারবাজার উচ্চ বিদ্যালয়, পঞ্চখণ্ড বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং জামিয়া মাদানিয়া আঙুরা কওমি মাদ্রাসা ভবনও রয়েছে ঝুঁকিতে। এছাড়াও শেওলা ইউনিয়নের বালিঙ্গা, দুবাগ ইউনিয়নের নয়াদুবাগ, দক্ষিণচরিয়া, মেওয়া এলাকার বসতবাড়ি ও রাস্তা হুমকির মুখে রয়েছে।

ইতোমধ্যে লাউজারিসহ আশপাশ গ্রামের কয়েকশ বিঘা আবাদি জমি নদীতে চলে গেছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। ভাঙনে আবাদি জমি, ফলের বাগান, গাছগাছালি জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে। উপজেলার প্রাচীন বৈরাগীবাজারও কুশিয়ারা নদীর ভাঙনের শিকার। নদী তীরবর্তী বাজার ভাঙতে ভাঙতে এবার বৈরাগীবাজার কেন্দ্রীয় মসজিদ ও খেয়াঘাট রাস্তা বিলীন প্রায়। এ অবস্থায় স্থানীয় মুসল্লিরা নদী ভাঙ্গন রোধে প্রবাসীসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা কামনা করেছেন।

নদীর ভাঙ্গনে আঙুরা মোহাম্মদপুর গ্রামের ১০ হাজার লোকের চলাচলের একমাত্র রাস্তার অর্ধেক অংশ বিলীন হয়ে গেছে। এখনই ভাঙ্গন ঠেকানোর উদ্যোগ না নিলে রাস্তার বাকি অংশ বিলীন হয়ে যাবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কুশিয়ারা নদীর পাশ দিয়েই চলে গেছে আঙুরা মোহাম্মদপুর-ফাড়িরবাজার রাস্তা। শুধু এই রাস্তা দিয়েই আঙুরা মোহাম্মদপুর গ্রামের মানুষ উপজেলা শহরে যাতায়াত করতে পারেন। এক কিলোমিটার দীর্ঘ এ রাস্তার কিছু অংশ পাকা, কিছু অংশ ইট বিছানো আবার কিছু অংশ কাঁচা। ভাঙ্গনে ইতিমধ্যে এর অন্তত অর্ধেক অংশ বিলীন হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেও রাস্তাটির প্রস্থ ১৪ ফুট ছিল। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে প্রশস্ততা কমে দুই থেকে আড়াই ফুটে দাঁড়িয়েছে।

ফাড়িরবাজারের সাবেক ব্যবসায়ী শামীম আহমদ বলেন, গ্রামের একমাত্র রাস্তাটি প্রায় সম্পূর্ণ ভাঙ্গনের কবলে পড়ায় মোটরসাইকেল ছাড়া অন্যান্য যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ কিছুদিন আগেও এ রাস্তা দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা, মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন যান চলাচল করত। এখন রাস্তা ভেঙে যাওয়া গ্রামবাসী অন্তত এক কিলোমিটার হেঁটে যানবাহনে ওঠেন।

গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল হক বলেন, ভাঙ্গন অব্যাহত থাকায় তাঁদের বসতভিটা ছাড়াও গ্রামের জামেয়া মাদানিয়া আঙুরা মোহাম্মদপুর মাদ্রাসা, মসজিদ ও একটি কালভার্ট হুমকির মুখে রয়েছে।

কুড়ার বাজার কলেজের প্রভাষক বিজিত আচার্য বলেন, গ্রামের একমাত্র রাস্তাটি দিয়ে স্কুল ও কলেজের অন্তত আড়াই হাজার শিক্ষার্থী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করে। কিন্তু নদীভাঙ্গনের কারণে রাস্তাটির বেশির ভাগ অংশ বিলীন হয়ে যাওয়ায় ছোট ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে ভয় পায়।

এদিকে সোনাই নদীর ভাঙ্গনে লাউতা ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আরো অন্তত: ৬টি গ্রাম। গাংপার, বাহাদুরপুর, কানলী, কালাইউরা, জলঢুপ বাজারও পড়েছে নদী ভাঙ্গনের কবলে।

বিয়ানীবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফসানা তাসলিম বলেন, ‘নদী ভাঙ্গনরোধে এরইমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন সময় আমাকে ফোনে ভাঙ্গনের বিষয়টি জানিয়েছেন। আমি তাঁদের বলেছি, বিষয়টি স্থানীয় সাংসদের ডিও লেটারের (আধা সরকারিপত্র) মাধ্যমে পাউবো কর্তৃপক্ষকে জানালে ভাঙ্গনরোধে দ্রুত একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে সুবিধা হবে। এরপরও বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।