অনলাইন ডেস্ক :
ইউরোপ ও জাপানে রেকর্ড তাপ প্রবাহের পূর্বাভাসের মধ্যে গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক মিলিয়ন মানুষ বিপজ্জনকভাবে উচ্চ তাপমাত্রার মুখোমুখি হয়েছে। এটি বিশ্ব উষ্ণায়নের হুমকির সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। এর মধ্যে মার্কিন সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে প্রতিবছর গরমজনিত কারণে প্রায় ৭০০ মানুষ মারা যায়। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে টেক্সাস পর্যন্ত প্রসারিত একটি শক্তিশালী তাপপ্রবাহ শীর্ষে উঠবে বলে মার্কিন জাতীয় আবহাওয়া পরিষেবা এক পূর্বাভাসে ‘সপ্তাহান্তে অত্যন্ত গরম এবং বিপজ্জনক’ পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করেছে। দিনের তাপমাত্রা পশ্চিমে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ থেকে ২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেশি হওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে একটি অ্যারিজোনায় বাসিন্দারা প্রতিদিন সূর্যের উত্তাপের তীব্রতার মুখোমুখি হচ্ছে।
অঙ্গরাজ্যের রাজধানী ফিনিক্স একাধারে ১৬ দিন ধরে ১০৯ ডিগ্রি ফারেনহাইটের (৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) উপরে রেকর্ড ধরে রেখেছে। শনিবার তাপমাত্রা ১১১ ডিগ্রি ফারেনহাইটে উঠেছে এবং সামনে এটি বেড়ে ১১৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটে দাঁড়াতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালি, পৃথিবীর উষ্ণতম স্থানগুলির মধ্যে একটি, সেখানে রোরবার তাপমাত্রা নতুন রেকর্ড ১৩০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছাতে পারে। শনিবার মধ্যাহ্ন নাগাদ তাপমাত্রা ইতোমধ্যে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল এবং এমনকি রাতে সর্বনিম্ন ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে। কর্তৃপক্ষ লোকদেরকে দিনের বেলা বাইরের কার্যকলাপ এড়াতে এবং ডিহাইড্রেশন থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। লাস ভেগাস আবহাওয়া পরিষেবা সতর্ক করেছে, উচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবেই অঞ্চলের মরুভূমির জলবায়ুর সাথে আসে বলে ধরে নেয়া ‘একটি বিপজ্জনক মানসিকতা! এই তাপপ্রবাহটি সাধারণ মরুভূমির তাপ নয়।’। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া অসংখ্য দাবানলের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যার মধ্যে রয়েছে রিভারসাইড কাউন্টির একটি, যেখানে ৩,০০০ একরেরও বেশি (১,২১৪ হেক্টর) বন পুড়ে গেছে এবং লোকদের সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে কতৃপক্ষ। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কানাডিয়ান সরকার জানিয়েছে, গড়ের চেয়ে বেশি থাকা তাপমাত্রার সাহায্যে দাবানল এরইমধ্যে কানাডায় এক কোটি হেক্টর জমিও পুড়িয়ে ফেলেছে বলে জানিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা।
গ্রীষ্মের সাথে সাথে এই ক্ষতি আরও আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইউরোপে ইতালি সপ্তাহান্তে রেকর্ড সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখোমুখি হয়েছে, তীব্র তাপপ্রবাহ কমার কোনো লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় আসছে সপ্তাহেও দক্ষিণ ইউরোপের বাসিন্দাদের অসহনীয় গরমের দাপট মোকাবেলা করতে হবে। ইতালি, স্পেন ও গ্রিস এরইমধ্যে কয়েকদিনের তুমুল গরমে পুড়েছে। রোম, ফ্লোরেন্সসহ ১৬টি শহরে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করেছে ইতালির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া আবহাওয়া কেন্দ্র ইতালীয়দের ‘গ্রীষ্মের সবচেয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং সর্বকালের অন্যতম তীব্র তাপপ্রবাহ’ এর জন্য প্রস্তুত থাকতে সতর্ক করেছে। রোমে সোমবারের মধ্যে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এবং কাল মঙ্গলবার এমনকি ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে, যা ২০০৭ সালের আগস্টে ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াাসের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। সিসিলি এবং সার্ডিনিয়া দ্বীপপুঞ্জ ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শুকিয়ে যেতে পারে, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা সতর্ক করেছে ‘আশঙ্কাজনকভাবে এটি ইউরোপে রেকর্ড সবচেয়ে উষ্ণ তাপমাত্রা’। ইতালির আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ গুলিও বেতি বিবিসিকে বলেছেন, তাপমাত্রা ১৯ থেকে ২৩ জুলাইয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছাবে, কেবল ইতালিতেই নয়, গ্রিসে, তুরস্কে এবং বলকান অঞ্চলেও। এই সময়ের মধ্যে এসব এলাকার অনেক অংশেই তাপমাত্রা নতুন রেকর্ড গড়তে পারে। গ্রিসের অন্যতম শীর্ষ পর্যটন আকর্ষণ অ্যাথেন্স অ্যাক্রোপলিস রোববার দিনের উষ্ণ তাপমাত্রার সময় তৃতীয় দিনের মতো চলমান কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া ফ্রান্সে উচ্চ তাপমাত্রা ও খরা কৃষি শিল্পের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় আবহাওয়া সংস্থার রেকর্ড অনুসারে গত জুন ফ্রান্সে রেকর্ড দ্বিতীয়-উষ্ণতম মাস ছিল এবং কাল মঙ্গলবার থেকে দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে তাপপ্রবাহের সতর্কতা রয়েছে। অন্যদিকে, স্পেনের পরিস্থিতির সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে, আবহাওয়া সংস্থা গত শনিবার সতর্ক করেছে, আজ সোমবার থেকে আগামীকাল বুধবার একটি নতুন তাপপ্রবাহ ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণ আন্দালুসিয়া অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ডিগ্রি সেলসিয়াসের এর উপরে উঠে আসবে।
ইউরোপের এই তাপপ্রবাহ কয়েকদিনের মধ্যে বলকান অঞ্চলেও পৌঁছে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সার্বিয়া ও হাঙ্গেরির মতো অঞ্চলটির বেশ কয়েকটি দেশ কয়েকদিন ধরেই তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি দেখছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপানের পূর্বাঞ্চলে তাপমাত্রা রোববার (১৪ জুলাই) এবং আগামীকাল সোমবার ৩৮ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, আবহাওয়া সংস্থা সতর্ক করেছে যে তাপমাত্রা আগের রেকর্ডগুলো ছাড়িয়ে যেতে পারে। তীব্র তাপদাহের পর অবিরাম বৃষ্টিতে উত্তর ভারতে অন্তত ৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। রাজধানী নয়া দিল্লির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদী রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা ২০ মিলিয়নেরও বেশি লোকের মেগাসিটির নিচু এলাকাগুলোকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ভারতে বর্ষাকালে বড় ধরনের বন্যা এবং ভূমিধস সাধারণ ঘটনা, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এর তীব্রতা বাড়ছে। মরোক্কো এই সপ্তাহান্তে কিছু প্রদেশে গড় তাপমাত্রা ৪৭ সেলসিয়াসে দাঁড়িয়েছে, আবহাওয়া পরিষেবা জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে আরো বেশি পানি সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তাপদাহে জর্ডানে দাবানল সৃষ্টি হয়েছে, দেশটির সেনাবাহিনী দাবানল নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইরাকে গ্রীষ্মকালে সাধারণ তীব্র তাপদাহ দেখা যায়, টাইগ্রিস নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এই তীব্রতা আরো প্রকট হয়েছে। বাগদাদে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি তাপমাত্রা এবং হেয়ার ড্রায়ারের মতো শহরের মধ্যে দিয়ে বাতাস বইছে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি নির্দিষ্ট আবহাওয়ার ঘটনাকে দায়ী করা কঠিন হতে পারে, তবে বিজ্ঞানীরা জোর দিয়েছেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, জীবাশ্ম জ¦ালানির উপর নির্ভরতা এই তাপপ্রবাহের কারণ।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
গাজায় গত একদিনে নিহত ৫২