November 18, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, November 4th, 2022, 8:48 pm

বিয়ানীবাজারে হারিয়ে গেছে জলঢুপী কমলার সুদিন

ফাইল ছবি

জেলা প্রতিনিধি, সিলেট :

কমলালেবুর ভারে নুয়ে পড়েছে ডালটা। বাঁশের খুঁটিতে ঠেকা দিয়ে রাখা, যেন ভেঙে না পড়ে। পাশের গাছগুলোর শাখাও ভরে আছে পাকা-আধপাকা অজস্র কমলায়। মাত্র তিন বছর আগে বাংলা কার্তিক মাসে এমন দৃশ্যই ছিল সিলেটের বিয়ানীবাজারের জলঢুপ পাড়িয়াবহরের কমলাচাষি আবদুল ওয়াহিদের বাগানে।
তবে এবার কমলার ফলন কমে গেছে। আবদুল ওয়াহিদের ছেলে আব্দুল হামিদ সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় জানালেন, ‘ই-ফিরা কমলার ফলন একবারেউ ভালা অইছে না, কোনো ছুরত খাইবার বুঝ অইব।’
আবদুল ওয়াহিদ জানান, ছোটবেলায় দেখেছেন ঢাকা ও সিলেট থেকে পাইকারেরা কমলা কিনতে আসতেন তাদের বাগানে। হাজার হাজার কমলার ফলন হতো। অনেক সময় কমলা বিক্রি করতে ঢাকা ও সিলেটে যেতেন তার বাবা মন্তাজ আলী। তিনি নিজেও কমলা বেঁচতে ঢাকায় গিয়েছেন একসময়। ইদানীং জলঢুপি কমলার সেই সুদিন নেই। আগের দিনের কথাই তার বারবার মনে পড়ছে।
কমলার জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলো বিয়ানীবাজার উপজেলার জলঢুপ গ্রাম। কমলার জন্য দেশের বাইরেও খ্যাতি ছিল এই গ্রামের। এখানকার উৎপাদিত কমলা ‘জলঢুপের কমলা’ নামে খ্যাতি ছিলো। তবে এখন ধারাবাহিকভাবে কমছে এই গ্রামের কমলা চাষ। গ্রামের বেশিরভাগ চাষিই কমলা চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
সিলেট অঞ্চলে উৎপাদিত কমলার খ্যাতির কারণে কথায় সিলেটি টানকে ‘কমলার গন্ধ’ আখ্যা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এককালে সিলেটের পরিচিতিই গড়ে তুলেছিলো কৃষিজাত দুই পণ্য- চা আর কমলা।
তবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, বৈরি আবহাওয়া, পাহাড়ি জমি ও মাটির উর্বরতা কমে আসাসহ বিভিন্ন কারণে কমে গেছে জলঢুপী কমলার উৎপাদন। ফলে চীন, ভারত, ভুটান নেপালসহ বিদেশের কমলা দখল করে নিয়েছে দেশের বাজার।
অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে এগুলো পাওয়া যাওয়ায় বিক্রেতারা ঝুঁকে পড়েন বিদেশি কমলার প্রতি। এতে লোকসানের আশংকায় কৃষকরাও কমলা চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে ঐতিহ্য হারাতে বসছে জলঢুপী কমলা।
জলঢুপ এলাকার কমলা চাষি নিটোল ভট্টাচার্য বলেন, আগে আমাদের এলাকার প্রতিটি বাড়ির পাশেই কমলার বাগান ছিলো। কিন্তু এখন বেশিরভাগ কমলা চাষ ছেড়ে দিয়েছেন। এখন পুরো গ্রামের সবমিলিয়ে ২০/২৫ টি বাড়িতে কমলা বাগান দেখা যাবে। তিনি বলেন, এখন আগের মতো গাছ ফেলে রাখলেই বছর বছর ফল ধরবে না। এখন গাছ ও মাটির যত্ন নিতে হবে। পরিচর্যা করতে হবে। এখানকার কৃষকরা এসব ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশিক্ষণের অভাব, উদাসীনতা, গাছ ও মাটির পরিচর্যা না করার কারণে সিলেটে কমলা উৎপাদন কমছে। কৃষকদের প্রশিক্ষিত করাসহ এই অঞ্চলে কমলা চাষ বাড়াতে একটি প্রকল্পের কাজ চলছে বলেও জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালে সিলেটের কমলা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ‘বৃহত্তর সিলেট সমন্বিত কমলা চাষ উন্নয়ন’ নামে আট বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে চার জেলায় ২৫০টি বাগান করা হয়। এতে কমলা চাষে কিছুটা আগ্রহ বাড়লেও ২০০৮ সালে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষে মুখ থুবড়ে পড়ে কমলা চাষ।
আগের প্রকল্প শেষ হওয়ার ১১বছর পর সিলেটের কমলা চাষ বৃদ্ধিতে ২০১৯ সালে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ‘লেবু জাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প’ নামে ওই প্রকল্পর মাধ্যমে সিলেট ও মোলভীবাজারের ৯ উপজেলায় কমলার উৎপাদন বাড়াতে কাজ করা হচ্ছে। তবে চলমান প্রকল্পের সুফল এখনও পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিস্টরা।
বিয়ানীবাজার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আহমেদ রাশেদুন নবী বলেন, বিয়ানীবাজারের কমলা বাগানগুলোতে পরিচর্যার অভাব রয়েছে। তাছাড়া মাটি উর্বরতা হারালে এবং ফুল ফোটার সময় বেশী গরম থাকলে ফুল ও ফল ঝরে যেতে পারে।
তিনি বলেন, বিয়ানীবাজারের কমলা বাগানগুলির বেশিরভাগ মালিক প্রবাসে অবস্থান করেন। ফলে বাগানগুলির সঠিক পরিচর্চা হয় না। সেজন্য প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলনও হয় না। তবে আমরা সবসময়ই চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকি।
বিয়ানীবাজারে মোট ১৫০ টি কমলা বাগানে ৫০.৫২ হেক্টর জমিতে কমলা চাষ হয় বলে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। উপজেলার পাড়িয়াবহর, আষ্টসাঙ্গন, কালাইউরা, উছপাড়া ও বাড়ইগ্রামের প্রায় ১৫০টি বাগানে কৃষকরা রোপণ করে ছিলেন কমলার চারা। কিন্তু ৮ বছর পরিচর্যার পর ফল হলো শূন্য। এসব গাছের কমলা আকারে খুব ছোট আর ফলনও কম, এক গাছে ১৫/২০ টির বেশি ধরে না।
জানা যায়, ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে মৃত্তিকা গবেষণাগারের গবেষকরা সিলেটের কমলা চাষ নিয়ে গবেষণা চালান। এরপর রিপোর্টে তারা উল্লেখ করেন, মাটি অনুর্বর হয়ে পড়ায় সিলেটে কমলার চাষ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মাটিতে সার প্রয়োগ করে গাছের সঠিক পরিচর্যা ও রোগবালাই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে কমলা চাষ করে লাভবান হওয়া সম্ভব।
বিয়ানীবাজারে কমলার সুদিন আবারও ফিরিয়ে আনার জন্য চাষিদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ, সেচের জন্য ফুডপাম্প, বাজারজাতকরণ ও কমলা সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপনের দাবি করেছেন তারা। তাদের বিশ্বাস, সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে আবারও ফিরে আসবে বিয়ানীবাজারের জলঢুপী কমলার ঐতিহ্য।