April 20, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, December 24th, 2021, 8:34 pm

বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাড়ছে ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

টাকা আছে, কিন্তু পকেটে নেই। ব্যাংকে বা সিন্দুকেও সেই টাকা রাখা হয়নি। রাখা হয়েছে ইন্টারনেটে। কোনো দিন ছুঁয়েও দেখা যাবে না অনলাইনে রাখা ওই টাকা। শুধু ভার্চ্যুয়াল জগতের এ মুদ্রাকেই বলা হয় ডিজিটাল মুদ্রা বা ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা।
প্রচলিত মুদ্রাব্যবস্থার মতো সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল মুদ্রা ছাপায় না। ‘মাইনিং’ নামের একটি জটিল গণনা পদ্ধতিতে একেকটি ডিজিটাল মুদ্রা তৈরি হয়। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত এক বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সব ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতিটি লেনদেন পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘ব্লকচেইন’। এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাধারণ লেনদেনসহ বন্ড, স্টক ও অন্যান্য আর্থিক সম্পদের কেনাকাটাও করা যায়।
ক্রিপ্টোকারেন্সি মূলত একধরনের বিকেন্দ্রীকৃত প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে নিরাপদে অর্থ পরিশোধ করা যায়। আমানতকারীর নাম গোপন রেখে এবং ব্যাংকে না গিয়েই অর্থ জমা রাখা যায়।
জানা যায়, সামনের দিনগুলোয় ডিজিটাল মুদ্রানির্ভরতা বাড়বে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সাল নাগাদ বৃহৎ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহার ২০ শতাংশ বাড়বে। তবে এতে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগকারীদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। বিভিন্ন লেনদেনের ক্ষেত্রে কেবল বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করবে। এ ছাড়া ক্রিপ্টোকারেন্সি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন নীতিমালার আওতায় আসতে বাধ্য হবে।
ডিজিটাল মুদ্রার আদান-প্রদান হয় অনলাইনে। বিনিময়ের সব তথ্য গোপন থাকে, বেশির ভাগ সময়েই থাকে অজ্ঞাত। এ ধরনের ডিজিটাল মুদ্রাকে বলা হয় ক্রিপ্টোকারেন্সি। এ ধরনের মুদ্রার বিনিময়ে ব্যবহার করা হয় ক্রিপ্টোগ্রাফি নামের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্রচলিত ভাষা বা সংকেতে লেখা তথ্য এমন একটি কোডে লেখা হয়, যা ভেঙে তথ্যের নাগাল পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অর্থাৎ ক্রিপ্টোগ্রাফি পদ্ধতিতে ব্যবহারকারী ছাড়া অন্য কারও কোনো কেনাকাটা বা তহবিল স্থানান্তরের তথ্য পাওয়া বেশ কঠিন।
কানেকটিকাটের স্ট্যামফোর্ডভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গার্টনারের বিশ্লেষক অ্যাভাইভাহ লাইটান জানান, বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল মুদ্রা হিসেবে স্ট্যাবলকয়েন্স ও সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সিজ (সিবিডিসি) ব্যবহার করবে।
সিবিডিসি নকটা নতুন কনসেপ্টের ডিজিটাল মুদ্রা। ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো এটাও ব্লকচেইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যাতে মধ্যস্থতায় কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন পড়ে না। সিবিডিসির মান ইচ্ছেমতো বাড়ানো-কমানো যাবে না। বিটকয়েন ও ইথারিয়ামের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সির মান যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে বা কমে, সে রকম কোনো সম্ভাবনা নেই সিবিডিসির বেলায়। কারণ এ ডিজিটাল মুদ্রার মান কোনো দেশের স্থানীয় মুদ্রার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তবে তা পুরোপুরি ডিজিটাল মুদ্রা।
জানা যায়, সিবিডিসি অনেকটা ডিজিটাল ক্যাশের মতো। কোন সিবিডিসি মার্কিন ডলারের মান কাগজে ডলারের সমান থাকবে। এটা মার্কিন ডলারের মতো ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু এর মালিকানা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ব্লকচেইনের মাধ্যমে নির্ধারণ হবে। গার্টনারের ফাইন্যান্স চিফ অব রিসার্চ আলেক্সান্ডার ব্যান্ট জানান, নিত্য পরিবর্তনশীল ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে লেনদেনে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা শঙ্কায় থাকবে, এটা সহজেই অনুমেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত ডিজিটাল মুদ্রা প্রচলনের ফলে বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোও তাতে লেনদেনের সাহস পাবে।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমরা হয়তো ক্রিপ্টোকারেন্সি বিপ্লবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তখনই তা গ্রহণ করবে যখন এটা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে এবং বাজারে এর অস্থিতিশীলতা কমবে। ডিজিটাল মুদ্রার ভার্চুয়াল মানে স্থিতিশীলতার পাশাপাশি তা আরো সহজলভ্য করা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। তখন হয়তো অনেক প্রতিষ্ঠানকে দেখা যাবে তারা তাদের আংশিক লেনদেন এসব মুদ্রায় পরিচালনা করছেন। ভবিষ্যৎ বাজারের দিকে তাকিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি গার্টনারের সুপারিশ, তারা যেন ধীরে ধীরে ডিজিটাল মুদ্রায় লেনদেনে অভ্যস্ত হয়। এটা ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধিতে এবং বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবে। ডিজিটাল মুদ্রা পছন্দ করেন কিংবা না করেন, এটাই ভবিষ্যতের শক্তিশালী লেনদেন মাধ্যম হতে যাচ্ছে।
জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোপনে ও নিরাপদে যোগাযোগের জন্য ক্রিপ্টোগ্রাফি পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল। গাণিতিক তত্ত্ব ও কম্পিউটার বিজ্ঞানের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিপ্টোগ্রাফিরও উন্নতি হয়েছে। এতে অনলাইনে ডিজিটাল মুদ্রা সংরক্ষণ ও আদান-প্রদানের বিষয়টি আরও নিরাপদ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
অবশ্য এত নিরাপত্তা সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে ডিজিটাল মুদ্রার বিভিন্ন বিনিময় প্রতিষ্ঠানে বেশ কটি চুরির ঘটনা ঘটেছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বের প্রথম ডিজিটাল মুদ্রা হিসেবে বিটকয়েনের আবির্ভাব ঘটে। বর্তমানে ইন্টারনেটে এক হাজারেরও বেশি ক্রিপ্টোকারেন্সি আছে। কয়েনচেক থেকে চুরি হয়েছে স্বল্প পরিচিত মুদ্রা এনইএম। গত বছরের ডিসেম্বরে নাইসহ্যাশ নামের স্লোভেনিয়ার একটি কোম্পানির মাত কোটি ডলারের বিটকয়েন চুরি হয়। বিটকয়েন চুরির ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালেও। এরও আগে ২০১৪ সালে মুদ্রা চুরির শিকার হয়েছিল আরেক বিনিময় প্রতিষ্ঠান এমটিগক্স। তাদের নেটওয়ার্ক থেকে ৪০ কোটি ডলার চুরি গিয়েছিল। চুরির ঘটনা স্বীকার করার পর ওই প্রতিষ্ঠান শেষে বন্ধই হয়ে যায়।
পরিচয় গোপন ও লেনদেন ব্যবস্থায় কঠোর নিরাপত্তাÑএই দুটি বিষয়ই হলো ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চ্যুয়াল মুদ্রাব্যবস্থায় আকৃষ্ট হওয়ার প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়। এই ব্যবস্থায় একবার লেনদেন হওয়ার পর তা ফিরিয়ে আনা কঠিন। একই সঙ্গে লেনদেনের খরচ কম হওয়ায় এটি গ্রাহকদের কাছে বেশি নির্ভরযোগ্যতা অর্জন করেছে। এর প্রযুক্তিব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকৃত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, সবার হাতের কাছেই থাকে ডিজিটাল মুদ্রা। যেখানে প্রচলিত মুদ্রাব্যবস্থায় ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট না খুললে সেবা পান না কোনো গ্রাহক।
ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজারে আকৃষ্ট হওয়ার আরেকটি কারণ হলো এতে কম বিনিয়োগ করেই ব্যাপক লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কারণ, প্রচলিত মুদ্রাব্যবস্থার তুলনায় ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলোর বিনিময় মূল্যের ওঠা-নামা বেশি। তাই রাতারাতি ধনী হওয়ার সুযোগও থাকে। ঠিক এই কারণেই সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিটকয়েন বা অন্যান্য শীর্ষ ডিজিটাল মুদ্রায় বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে।
তবে এর কিন্তু উল্টো দিকও আছে। অর্থাৎ দর বেড়ে গেলে যেমন ধনী হওয়ার সুযোগ আছে, তেমনি হুট করে দর নেমে গেলে রাস্তাতেও নামতে পারেন। আবার কঠোর গোপনীয়তা থাকায় অবৈধ কর্মকা–সংশ্লিষ্ট লেনদেনে পছন্দের শীর্ষে আছে ক্রিপ্টোকারেন্সি। তাই বিনিয়োগকারীদের এসব বিষয়ে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে।