March 29, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, June 22nd, 2022, 9:36 pm

বৈদেশিক মুদ্রা শিল্পখাতের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতেই বেশি খরচ হচ্ছে

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

শিল্পখাতের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ডলার বেশি খরচ হচ্ছে। শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আনতে ডলারের ৫৭ শতাংশ ব্যয় হয়। তবে একক পণ্য হিসাবে জ্বালানি তেল আনার ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি ডলার ব্যয় হয়। যা মোট আমদানির সাড়ে ৯ শতাংশ। যদিও দেশের শিল্প খাত থেকেই সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। তারপরই রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। তাছাড়া বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ থেকে আসে মাত্র ৩ শতাংশ। সম্প্রতি আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বাড়ায় ও রেমিট্যান্স কমায় বাজারে ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে কোন কোন খাতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো যায় এবং কোন কোন খাতে কমানো যায় ওই বিষয়টিও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ওই আলোকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে ও ব্যয় কমাতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। অচিরেই আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চারটি প্রধান উৎস। সেগুলো হচ্ছে রপ্তানি আয়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক ঋণ। আর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের প্রধান খাত হচ্ছে দুটি। আমদানি ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ। তার বাইরে খুবই সীমিত আকারে ভ্রমণ, বিদেশে পড়াশোনা ও চিকিৎসা খাতে কিছু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশ ৭ হাজার ২০০ কোটি ডলারের কমবেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। তার বিপরীতে ব্যয় হয় সাড়ে ৬ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। বাকি থাকে ৭০০ কোটি ডলার। তার মধ্যে ভ্রমণ, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে একটি বড় অংশ যাচ্ছে। আর সামান্য কিছু যাথাকে তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যোগ হয়। এভাবেই দেশের রিজার্ভ বাড়ছে। কিন্তু করোনার পর হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। আর ব্যয় বাড়লেও পরিমাণগতভাবে আমদানি কম হচ্ছে। যেভাবে আমদানি ব্যয় বেড়েছে, সেভাবে রপ্তানি আয় বাড়েনি। পাশাপাশি কমে গেছে রেমিট্যান্স। তাতে দেশের রিজার্ভে চাপ বেড়েছে। মোট আমদানি ব্যয়ের ৬০ শতাংশ রপ্তানি আয় দিয়ে মেটানো হয়। বাকি ৪০ শতাংশ রেমিট্যান্স থেকে মেটানো হয়। অন্যান্য ব্যয়ও রেমিট্যান্স থেকেই মেটানো হয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৫৮ কোটি ডলার। আর জুলাই থেকে মে পর্যন্ত রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪ হাজার ৭১৭ কোটি ডলার। রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৯১৯ কোটি ডলার। বৈদেশিক বিনিয়োগ হিসাবে গড়ে আসে ২৬০ কোটি ডলার। ঋণ হিসাবে ২২০ কোটি ডলার। ঋণ পরিশোধ করতে হয় বছরে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৫৮ কোটি ডলার। তার মধ্যে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি। অর্থাৎ মোট আমদানি ব্যয়ের ৫৭ শতাংশেরও বেশি। ওই সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে খরচ হয়েছে ২ হাজার ২১৩ কোটি ডলার। যা মোট আমদানির ৩৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। তার মধ্যে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি করে সেগুলো দেশীয় কারখানায় পরিশোধন করে বাজারে বিক্রি হয়। সেজন্য অপরিশোধিত ভোজ্যতেল শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে গণ্য করা হয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চে ৩১ কোটি ডলারের অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের তৈলবীজ আমদানি হয়েছে ৫৫ কোটি ডলারের। গার্মেন্ট শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল টেক্সটাইলের কাপড় আমদানি হয়েছে ৮১৯ কোটি ডলারের। দেশীয় বস্ত্র শিল্পে তুলা থেকে সুতা উৎপাদন করা হয়। ওই তুলা আমদানি হয়েছে ২৫ কোটি ডলারের। আর সুতা থেকে কাপড় তৈরি করে সেগুলো রপ্তানি করা হয় ২৪৬ কোটি ডলারের তেমন সুতা আমদানি হয়েছে। পোশাক শিল্পেরই কাঁচামাল কোপরা ৩৯ কোটি ডলার, সিনথেটিক ফাইবার ১১৮ কোটি ডলার ও রাসায়নিক পণ্য ৫৭৫ কোটি ডলারের আমদানি হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল অর্থাৎ পুরো তৈরি পণ্য নয় কিন্তু বিদেশে কাঁচামাল থেকে পণ্যের একটি মধ্যম রূপ দেয়া হয়েছে, যেগুলো দিয়ে দেশে পণ্য উৎপাদন করা হয় ৫৩৫ কোটি ডলারের এমন মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি হয়েছে। যা মোট আমদানির ৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। তার মধ্যে কয়লা ৫১ কোটি ডলার, সিমেন্ট ১৬ কোটি ডলার, ক্লিংকার ও স্টোন ৭৯ কোটি ডলার, বিপি শিট ৯৫ কোটি ডলার, টিন প্লেট ৯১ লাখ ডলার, পুরনো জাহাজ ৯৮ কোটি ডলার, লোহা ও স্টিল স্ক্র্যাপ ১৪২ কোটি ডলার, বিভিন্ন মেটাল ২৭ কোটি ডলার, পেপার ও পেপার বোর্ড ২৪ কোটি ডলার, অন্যান্য কাঁচামাল ৮৭ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় শিল্পের কাঁচামালের মধ্যে রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়। গত মার্চ পর্যন্ত ৮৬৪ কোটি ডলার পণ্য আমদানি হয়েছে। যা মোট আমদানির ১৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা বেড়েছে ৬০ শতাংশ।
এদিকে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চে ৩৮১ কোটি ডলারের শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে। যা মোট আমদানির ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। তার মধ্যে টেক্সটাইল যন্ত্রপাতি ৪২ কোটি ডলার, ট্যানারির যন্ত্রপাতি ১ কোটি ডলার, পাট খাতের ১ কোটি ডলার, গার্মেন্ট ৪৫ কোটি ডলার, ওষুধ ১৪ কোটি ডলার, প্যাকেজিং ৮০ লাখ ডলার ও অন্যান্য শিল্পের ৩০৫ কোটি ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। তাছাড়া ওই সময়ে ৩১১ কোটি ডলার বিবিধ খাতের শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে। যা মোট আমদানির ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। তাছাড়া অন্যান্য মেশিনারিজ ৮ কোটি ডলার, ডিজেল ইঞ্জিন ১৭ লাখ ডলার, কম্পিউটার ও যন্ত্রপাতি ৪৩ কোটি ডলার, মোটরসাইকেলের যন্ত্রপাতি ১৯ কোটি ডলার, বাইসাইকেলের পার্টস ১১ কোটি ডলার, লোহা ও স্টিল পণ্য ১৯ কোটি ডলার, মোটরসাইকেল ৫২ কোটি ডলার, অন্যান্য ইলেকট্রনিক সামগ্রী ১০ কোটি ডলার, ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার ৪ কোটি ডলারের আমদানি হয়েছে। তাছাড়া দেশে বিলাসবহুল পণ্য আমদানি বেড়েই চলেছে। তার মধ্যে গাড়ির যন্ত্রাংশ ১৮ কোটি ডলার, নতুন গাড়ি ৫২ কোটি ডলার, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ১০ কোটি ডলার, অন্যান্য বাণিজ্যিক পণ্য ৩১০ কোটি ডলার ও ফল ৩৯ কোটি ডলারের আমদানি হয়। ৪২৯ কোটি ডলারের বিলাসবহুল মোট পণ্য আমদানি হয়। যা মোট আমদানির ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ। আর বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬৮৭ কোটি ডলার। যা মোট আমদানি ব্যয়ের ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। তার মধ্যে চাল ও গম আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি ডলার। যা মোট আমদানির ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। চিনি ও লবণ আমদানিতে খরচ হয়েছে ৭৮ কোটি ডলার। যা মোট আমদানির ১ দশমিক ২৯ শতাংশ। গুঁড়োদুধ আমদানিতে খরচ হয়েছে ২৬ কোটি ডলার। যা মোট আমদানি ব্যয়ের শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ। এছাড়া পরিশোধিত ভোজ্যতেল ১০৬ কোটি ডলার, ফল ৩৯ কোটি ডলার, ডাল ২১ কোটি ডলার, পেঁয়াজ ১৪ কোটি ডলার, মসলা ২০ কোটি ডলার, পুরনো কাপড় ২১ লাখ ডলার, ওষুধ ৫৬ কোটি ডলার, অন্যান্য খাদ্য ১৩২ কোটি ডলারের আমদানি হয়েছে। তবে একক পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় জ্বালানি তেল। তাতে খরচও বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় তার আমদানি ব্যয় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ওই খাতে ব্যয় হয়েছে ৫৫৭ কোটি ডলার। যা মোট আমদানির ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। তার মধ্যে অপরিশোধিত তেল আমদানি হয়েছে ১০০ কোটি ডলারের। যা মোট আমদানির ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। পরিশোধিত তেল ৪৪৬ কোটি ডলারের। যা মোট আমদানির ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অন্যান্য খাতে ওই সময়ে পণ্য আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৩০ কোটি ডলারের। যা মোট আমদানির ১৭ শতাংশ। তার মধ্যে ৩১০ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক পণ্য। যা মোট আমদানির ৫ দশমিক ১২ শতাংশ। আর শিল্প খাতে ব্যবহারের ৭১৫ কোটি ডলারের পণ্য আনা হয়েছে। তার বাইরে বৈদেশিক ঋণের আওতায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৮১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। যা মোট আমদানির ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ওই প্রকল্পের জন্য ৭১৭ কোটি ডলার আমদানির অপেক্ষায় রয়েছে। যা মোট আমদানির ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট চলছে তা মোকাবিলা করার জন্য প্রতিটি খাতে ব্যাকআপ বা শতভাগ প্রভিশন রাখা প্রয়োজন। অর্থাৎ যে ডলার খরচ হবে তা যাতে কোনো না কোনো খাত থেকে আয় হয়। তাহলে বড় চাপ কমানো যাবে। সেজন্য আমদানি ও বিদেশ ভ্রমণ খাতে ডলার ছাড়ে আরো কঠোর হতে হবে।