April 25, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, March 28th, 2023, 9:43 pm

ব্যাংকে আশঙ্কাজনক হারে কমছে গ্রামীণ আমানত

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশে কর্মরত ব্যাংকগুলোতে আশঙ্কাজনক হারে কমছে গ্রামীণ আমানত। বিগত তিন মাসে ব্যাংকগুলোতে ৪ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা গ্রামীণ আমানত কমেছে। মূলত মূল্যস্ফীতির কারণেই গ্রামীণ জনগোষ্ঠির সঞ্চয় কমে যাচ্ছে। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাংলাদেশ রেকর্ড মূল্যস্ফীতি পার করছে। সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেককেই ভেঙে ফেলতে হচ্ছে ব্যাংকে থাকা সঞ্চয়। আর ব্যাংক আমানতে তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে এসেছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে ব্যাংকের আমানত সবচেয়ে বেশি কমছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। তার মধ্যে ৩ লাখ ৪১ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা ছিল গ্রামীণ আমানত, কিন্তু ডিসেম্বরে এসে এর পরিমাণ ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ মাত্র ৩ মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর গ্রামীণ আমানত কমে গেছে ৪ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। পরিস্থিতি খারাপ না হলে দেশের ব্যাংক খাতে আমানত সবসময়ই প্রবৃদ্ধির ধারায় থাকে। আবার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও ব্যাংকগুলোর আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। গ্রামে ব্যাংকের আমানত না বেড়ে উল্টো কমে যাওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। সূত্র জানায়, এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রামাঞ্চল থেকে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ সেবা চালুর পর থেকেই গ্রামীণ আমানত প্রবৃদ্ধির ধারায় ছিল। কিন্তু গত বছরের শেষ ৩ মাসে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আমানত স্থিতি ৫০৫ কোটি টাকা কমে গেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এজেন্টদের মাধ্যমে ৩০ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ হয়। ডিসেম্বর শেষে তা ৩০ হাজার ১৫৭ কোটি টাকায় নেমে আসে। এজেন্ট ব্যাংকিং আমানতের ৭৯ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের। মূলত গত বছরের শুরু থেকেই দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এর মধ্যে সরকার আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পেট্রল, অকটেন, ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। জ্বালানির অপ্রত্যাশিত মূল্যবৃদ্ধিতে দেশে প্রতিটি পণ্য ও সেবার দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। সরকারি হিসাবেই গত বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর ডিসেম্বরে হয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে ১০০ শতাংশেরও বেশি। আর জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব গ্রামের মানুষের সঞ্চয়ের ওপর পড়েছে। দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ৭৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ শহরাঞ্চলের। বাকি ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ ব্যাংকের গ্রামীণ শাখাগুলোর মাধ্যমে এসেছে। গত বছরের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানত বেড়েছে ১১ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ওই সময় শহরাঞ্চলে ১৫ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা বাড়লেও গ্রামে ৪ হাজার ২৯৪ কোটি টাকার আমানত কমে গেছে। আবার অন্যসব শ্রেণীর ব্যাংকে আমানত বাড়লেও গত বছরের শেষ তিন মাসে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোয় কমেছে ১০ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। সূচনালগ্ন থেকে এই প্রথম ইসলামি ব্যাংকিংয়ের আমানত কমেছে। এদিকে ব্যাংকে আমানত কমলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ার কথা। কিন্তু তাতেও ভাটার। গত জানুয়ারিতে মাত্র ৩৭ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে নগদায়নই হয়েছে বেশি। ৭ মাসে ৩ হাজার ৬৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমেছে। জানুয়ারি শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯৪০ টাকায় নেমে এসেছে। গত জুন শেষে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের ঋণ ছিল ৩ লাখ ৬৪ হাজার ১০ কোটি টাকা। মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিজস্ব আয় দিয়ে সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করতে পারছে না। ঠরণ মাস শেষে হাতে কোনো সঞ্চয়ও থাকছে না। বাধ্য অনেকে ব্যাংকে থাকা সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। তাছাড়া আমানতের মুনাফার ওপর সরকার বাড়তি কর আরোপ করেছে। ব্যাংক খাতে আমানত কমে যাওয়ার পেছনে এর ভূমিকাও আছে। পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দেশের ব্যাংক খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতাও বেড়েছে। ফলে গত বছরের জুন থেকেই ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নেয়ার প্রবণতা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নোট ইস্যু করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬২ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল আরো বেশি। অন্যদিকে তারল্য সংকটে পড়লে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করতো। কিন্তু এক বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোই তারল্য সংকটে ভুগছে। তাদেরই এখন প্রতিনিয়ত মুদ্রাবাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে চলতে হচ্ছে। তারল্য সংকটের কারণে কলমানি বাজারে সুদহার রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। একদিন মেয়াদি কলমানির সুদহার ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ আর সাতদিন মেয়াদি আমানতের সুদহার ৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। তাছাড়া আমদানি দায়ের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য অব্যাহতভাবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়েছে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। এর মাধ্যমে শুধু চলতি অর্থবছরেই ১ লাখ ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকা বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। দেশের ব্যাংক খাতে আমানত ও তারল্য সংকটের পেছনে বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতারও ভূমিকা রয়েছে। গ্রামীণ মানুষের আমানত কমে যাওয়া প্রসঙ্গে ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা জানান, আগে রেমিট্যান্সের অন্তত ২০ শতাংশ অর্থ ব্যাংক হিসাবে আমানত হিসেবে জমা থাকতো। কিন্তু এখন রেমিট্যান্সের ৫ শতাংশ অর্থও ব্যাংকে আমানত হিসেবে থাকছে না। বিদেশ থেকে অর্থ আসার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রাহক পুরো টাকাই তুলে নিচ্ছে। মূলত জীবনধারণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এমনটি হচ্ছে। ইসলামি ব্যাংকে এমন অনেক গ্রাহক আসছে যারা তাদের দীর্ঘদিনের সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। অনেকে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই দীর্ঘমেয়াদি আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট/ডিপিএস) তুলে নিতে আসছে। আর অল্প কিছু গ্রাহক আতঙ্কিত হয়েও আমানত তুলে নিয়েছে।